বাজার নিয়ে অন্ধের হস্তী দর্শনের বাইরে আমাদের কৌশলটা কী?
গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম
বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এক অন্ধের হস্তী দর্শন ধরনের পরিস্থিতি চলমান। পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা থিংক ট্যাংকের আলাপ শোনে আমি বুঝতে পারি না কী চলছে এবং কী করণীয়। সরকার হাতড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ইউক্রেইন যুদ্ধ ইত্যাদি। জনগণ হাতড়ায় সিন্ডিকেট। সে আরেক ভূত, সবাই ভাবে সিন্ডিকেট আছে এবং চাইলেই সরকার বোধহয় সিন্ডিকেট নির্মূল করে ফেলতে পারে। কিন্তু সিন্ডিকেটটা আসলে দেখতে কেমন, তারা কীভাবে অপারেট করে, তাদের কোথায় পাওয়া ও ধরা যাবে, এবং তাদের নিয়ে কী করা হবে। এসব কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
জনতার এ হাতড়ানো দেখে করিৎকর্মা ম্যাজিস্ট্র্যাট আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দপ্তরও বাজারে বাজারে হাতড়ায় ব্যবসায়ীর চালানের কপি। তা দেখে ধরে ফেলে সিন্ডিকেট। জরিমানা করে লাখ টাকা। এ এক আশ্চর্য মশকরা। আবার কেউ কেউ কারণ হিসেবে হাতড়ায় দুর্নীতি। অতি বড়লোক ক্রেতারা (যাদের প্রচুর অবৈধ অর্থ) বাজারে পণ্যের দামের দিকে তাকায় না, তাদের এ প্রবণতাও নাকি বাজারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আমার প্রশ্ন, তারা বাজারের কত শতাংশ (আমার অনুমান মোট ক্রেতার অতি ক্ষুদ্র অংশ) এবং অর্থনীতির জ্ঞান বলে বড়লোকেরা তাদের আয়ের অতি অল্প অনুপাত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের জন্য ব্যয় করে, পক্ষান্তরে মধ্যবিত্ত ও গরিব অনুপাতে ব্যয় করে বেশি। অবৈধ অর্থের মালিকরা কতটা বাজারকে প্রভাবিত করে এ হাইপোথিসিস নিয়েও সন্দিহান আছি। হতে পারে এসব কারণ মিলেমিশে তৈরি করেছে আজকের বাজার পরিস্থিতি।
তাহলে ব্যবস্থা নিতে গেলে আগে মেপে দেখতে হবে কোন কারণের প্রভাব কতটা। বাজার বুঝতে গেলে মোটাদাগে তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়। ডিমান্ড সাইড তথা ক্রেতার আচরণ (আয়, পছন্দ অপছন্দ), সাপ্লাই সাইডের বৈশিষ্ট্য, কতজন বিক্রেতা মাঠে আছে, তাদের প্রতিযোগিতার ধরন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা-ঝুঁকি। আঁকতে হবে সাপ্লাই চেইনের ম্যাপ। দেখতে হবে কত হাত বদল হয়ে ক্রেতার কাছে যায় একটি পণ্য এবং কোন হাতবদলের সময় মার্জিন কতটুকু এবং এসব বিষয় চালের বাজারে একরকম, ডিমের বাজারে আরেক রকম, তরমুজের বাজারে সম্পূর্ণই হতে পারে আলাদা। পণ্যভেদে এ ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য অন্ধরা দেখতে পায় না।
পলিসিতে এ অন্ধত্ব দূরীকরণে আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ভোক্তা সংরক্ষণ দপ্তর কি এঁকেছেন দশ পনেরোটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সাপ্লাই চেইনের ম্যাপ? বাজার থেকে নিয়েছেন ডেটা? মাপামাপি করে দেখেছেন কেন কোন পণ্যের বাজার রমজানে একরকম আচরণ করে আর বছরের অন্য সময় করে ভিন্ন আচরণ? এ কাজে যুক্ত করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদদের, অথবা সাপ্লাই চেইন বিশেষজ্ঞদের কোনো দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রকল্পে? আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশে কৃষি ও এফএমসিজি পণ্য খাতে সাপ্লাই চেইন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রফেশনাল ও গবেষকরা তৈরি হয়েছেন গত দুই দশকে। তাদের ব্যবহার করে অন্ধত্ব দূরীকরণের কোনো চেষ্টা এখনো নেই।
সাপ্লাই চেইনে ডিজরাপশন কোভিডের পর পাশ্চাত্যে দুশ্চিন্তার এক বড় কারণ। বাংলাদেশেও তো এর প্রভাব পড়েছে। আমেরিকার এ বিষয়ে রেসপন্স কী? ২০২১ সালে প্রেসিডেন্টের এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে নানা উদ্যোগ ও গবেষণা শুরু হয়েছে। কানাডা তৈরি করেছে আলাদা ন্যাশনাল সাপ্লাই চেইন অফিস। ডিজিটাল ডেটা কালেকশন আর অ্যান্ড টু এন্ড ভিজিবিলিটি তৈরির প্রচেষ্টা। যাতে ভবিষ্যতে মহামারি, অথবা যুদ্ধের সময় তারা প্রস্তুত থাকতে পারে। কোভিডের সময় তারা লক্ষ্য করেছে তাদের অ্যান্ড টু অ্যান্ড সাপ্লাই চেইনের ডেটা ও ভিজিবিলিটি সরকারের কাছে নেই। ফলে পলিসি রেসপন্সে তারা অন্ধের হস্তী দর্শনের মধ্যে পড়েছিল। এ থেকে উঠে আসতে তারা এখন তৎপর, তাদের টাইম বাউন্ড লক্ষ্য ও কৌশল আছে। বাজার নিয়ে অন্ধের হস্তী দর্শনের বাইরে আমাদের কৌশলটা কী? ৭-৪-২৪। ফেসবুক থেকে