খেলাপি ঋণ আদায়ে নতুন উদ্যোগে কি সফলতা আসবে?
মিজানুর রহমান
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলেছেন এই উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা ও মুনাফায় প্রভাব ফেলেছে। জনগণের আস্থা কমিয়েছে। এছাড়া তহবিল প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করছে যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তিতে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণ সাধারণত দু’ভাবে হয়ে থাকে প্রথমত অনিচ্ছাকৃত ব্যবসায়ীক কার্যক্রম/প্রাকৃতিক দূর্যোগ/অর্থনৈতিক কারণে ঋণ খেলাপি হতে পারে, অন্যটি হল ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি। এদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নতুন সার্কুলার জারি করেছেন। সার্কুলার অনুযায়ী নতুন করে কোন গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলে সে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি কিনা তা ৩০ দিনের মধ্যে যাচাই করতে হবে। কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহৃিত হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য প্রদানের জন্য ১৪ দিনের সময় দিয়ে চিঠি দেওয়া হবে। ঋণ গ্রহীতার বক্তব্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হলে অথবা তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপস্থিত না হলে ব্যাংক এককভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ৭ দিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতা যদি ক্ষুব্ধ হন তাহলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আপিল করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই চূড়ান্ত বলে গন্য হবে। যিনি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত হবেন তিনি কোন ধরনের সুদ মওকুফ পাবেন না। তার ঋণটি পুন:তফসিল/নবায়ন করার সুযোগ থাকবে না। ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তিনি খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত থাকবেন এবং এ সময়ের মধ্যে অন্য কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ধরনের ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি অন্য কোন কোম্পানি খুলতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও অন্যান্য সম্মাননা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার নাম বিবেচনায় আসবে না। এখন থেকে যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হবেন তাদের নামের তালিকা গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা ঋণের সমূদয় টাকা পরিশোধ করলেও ৫ বছর পর্যন্ত কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। যথাযথ ভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ না করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা মোকদ্দমা ও করতে পারবে।
আরো একটি উদ্যোগের খবর হল বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার জন্য দূর্বল ব্যাংকের তালিকা করেছে। খেলাপি ঋন আদায়ে এর ফলে ভূমিকা রাখবে। তারা ৫৪টি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ৩৪টি ব্যাংক দূর্বল ব্যাংক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে থেকে সবল ব্যাংকের সংগে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।পদ্মা ব্যাংক এর খেলাপি ঋণের পরিমান ৬২ শতাংশ। এটি দূর্বল ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত। এরি মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের সাথে পদ্মা ব্যাংকের একীভূত করার চুক্তি সই হয়েছে। রাষ্ট্রাত্ব ৪টি ব্যাংক একীভূত করার নীতগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেমন- সোনালী ব্যাংকের সাথে ডিবি বিএল এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এর সাথে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং অগ্রনী ব্যাংকের সাথে বেসিক ব্যাংকের একীভূত করার আলোচনা চলছে।
৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংক খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তার মধ্যে ৯টি রেড জোনে চলে গেছে। ইয়োলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে তিনটি ব্যাংক আবার রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে, এর মধ্যে ৮টি বিদেশি ব্যাংক। গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মূখ পাত্র মেজবাহউল হক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন আগামী ডিসেম্বর এর মধ্যে দূর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। সেটা না হলে আগামী বছরের মধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দূর্বল ব্যাংকের তালিকায় পড়বে তাদের একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোন ব্যাংক একীভূত হলেও আমানতকারীদের স্বার্থক্ষুন্ন হবে না। তিনি তাও বলেন ব্যাংকের এই শ্রেণিকরন চূড়ান্ত নয়। অন্যদিকে একীভূত হলে দূর্বল ব্যাংকের পরিচালক ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। আবার দূর্বল ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডিকে একীভূত করার সময় চাকুরীচ্যুত করা হবে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ও নীতিমালা জারি করেছে। যেমন- এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেক্টর বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বয়স সীমা ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হতে হবে। এমডি নিয়োগের বেলায় খেলাপি ঋণ অবলোপন ও আদায়ের ক্ষেত্রে যাদের দক্ষতার স্বীকৃতি আছে এরা অগ্রাধিকার পাবেন। এমডি নিয়োগ পেতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা কমিটির মৌখিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ এবং উত্তীর্ন হতে হবে। হঠাৎ করে কেউ এমডির পদ ছাড়তে পারবেন না। তিন বছরের জন্য এম ডি নিয়োগ হবেন। আশা করা যাচ্ছে এ প্রক্রিয়ায় এমডি নিয়োগ হলে খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি ফিরে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার জন্য যে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে ওই কমিটির স্বচ্ছতার উপর নির্ভর করবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণী চিহ্নিত হবেন কি হবেন না। তাই ঐ কমিটি হতে হবে স্বচ্ছ আর যোগ্য। ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে ও স্বচ্ছতার প্রয়েজন হবে।এর নীতিমালা একদম স্বচ্ছ হতে হবে। সবল ও দূর্বল ব্যাংক একীভূত হলে তার ঝুঁকিটা কি হতে পারে আগে থেকেই হিসাব কষতে হবে। দেখতে হবে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
বিশেষজ্ঞরা তাও মনে করেন উদ্যোগ যাই নেয়া হউক তার সুফল পেতে হলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ দুুই/একটি উদ্যোগ নিলে সমস্যা কেটে যাবে না। এর সমস্যা এখন অনেক গভীরে। এখানে দ্বৈত শাসন চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক বিভাগের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে তাহলে হয়ত সম্ভব।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এর ডিষ্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, খেলাপি ঋণের এখন যা অবস্থা তা গত ২০-২৫ বছরের পুঞ্জিভূত অনিয়মের ফল।আগেই দরকার ছিল তারপরও দেরিতে হলেও যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা যায় তাহলে ভালো।তাদের চিহ্নিত করে শান্তির আওতায় আনতে হবে।আর এটা করতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে।কোন ধরনের চাপ বা রাজনীতির কাছে নতিস্বীকার করা যাবে না। তারই সাথে সাথে যে সমস্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িত মনে হবে তাকে ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তারই সাথে সাথে ব্যাংকিং বিচার ব্যবস্থার ও সংষ্কার করা প্রয়োজন আছে। আশাকরি উদ্যোগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃংখলা ফিরে আসবেই। লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার