কোনটা রেখে কোন পণ্য বর্জন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি
সাঈদ তারেক
বাংলাদেশের স্বাধীন বা জাতীয় অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দিয়ে গেছেন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। ভদ্রলোক ছিলেন সিএ বা চার্টার্ড একাউনটেন্ট। ষোলো আনা পেশাদার মানুষ। ৯১ সালে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়ে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টোপ পুরোটা গেলেন। এই টোপ হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। যার মূল কথা বাজার থাকবে অবারিত, যেকোনো দেশ যেকোনো দেশে তার পণ্য বিক্রি করতে পারবে। আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারবে না। এই সংস্থা দুটোর কাজ হচ্ছে গরিব অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নানা রকম ঋণ অনুদানের ফাঁদে ফেলে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণে বাধ্য করা। এসব দেশকে শিল্পোন্নত দেশের পণ্যবাজারে পরিণত করা।
কোনো দেশের স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যাপক শিল্পায়ন। মুক্তবাজার অর্থনীতি দেশীয় শিল্পায়ন নিরুৎসাহিত করে। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমদানিকৃত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একসময় শিল্প কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতি হয়ে পড়ে আমদানিনির্ভর। জাতীয় পুঁজির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠে মুৎসুদ্দি পুঁজি। এ ধরনের বেনিয়া অর্থনীতি দেশকে পরনির্ভর করে তোলে। বেনিয়াদের যেহেতু কোনো চরিত্র থাকে না, দেশপ্রেম থাকে না, তারা জনগণকে জিম্মি করে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তোলে। দেশ যায় রসাতলে। মানুষ মরতে বসে। সরকার?কে বোঝানো হয় মুক্তবাজারে ঢুকে আমদানি অবারিত করে দিলে একেবারে সাথেসাথে নগদ প্রাপ্তি। বিদেশ থেকে মাল আসবে আর ট্যাক্স কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট বাবদ নগদ এসে কোষাগারে জমা হতে থাকবে। শিল্পায়নের পথে গেলে সরকারের ট্যাকে আশু অর্থ আমদানির সম্ভাবনা নেই। কবে শিল্প কারখানা বসবে প্রডাকশনে যাবে, তারপর মাল বিক্রি করে ট্যাক্স দেবে। তার ওপর শ্রমিকদের প্যারা। ক’দিন পরপরই আন্দোলন হরতাল। আমাদের স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশের সেই শুরু।
এরশাদের নামে নানা অপবাদ, কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন দেশপ্রেমিক। শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন নিজেদের অর্থনীতি নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের প্রবল চাপ তার ওপরও ছিল। তা সত্ত্বেও শাসনকাল পর্যন্ত দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির অবাধ প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। চেয়েছিলেন অর্থনীতি আমদানিনির্ভর না করে দেশীয় শিল্প ও কৃষির ওপর গড়ে তুলতে। একপর্যায়ে কিছু কিছু পণ্য আমদানির অনুমতি দিলেও দেশীয় শিল্পের প্রটেকশনে একশ চৌদ্দটা পণ্যের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা জারি রাখেন। তার এই নীতির কারণে ওই সময় ওষুধশিল্প কসমেটিকস ইলেক্ট্রিক্যাল অটোমোবাইল রেডিফুড সাইকেল রিকশার চাকা বিভিন্ন পার্টস- ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে বহু শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়, মানুষ দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে থাকে। জাতীয় অর্থনীতির একটা ভীত গড়ে উঠতে থাকে। জিয়াউর রহমানের আমলে মুক্তবাজারে যাওয়ার চাপ অতটা ছিল না, তারপরও তিনি শিল্পায়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তার আমল থেকেই গামের্ন্টস শিল্পের যাত্রা। প্রাইভেট সেক্টরে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে সহায়তায় বিএসআরএস বা বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা গঠন করেছিলেন। এই সংস্থা থেকে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সমাজতন্ত্র সন্নিবেশিত হলেও না রাজনৈতিক না অর্থনৈতিক কোনো কাঠামোই সে লক্ষ্যে প্রস্তুত ছিল না। অবাঙালি পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া কয়েকটা ভারী শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় মলিকানায় নিয়ে নেওয়াকে বোঝানো হতো সমাজতন্ত্র। তো কিছুদিনের মধ্যে সে প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষকদের ভক্ষণের খোরাকে পরিণত হলে একেএকে সবগুলোর লালবাতি জ্বলে। জিয়াউর রহমানের আমলে নামমাত্র মূল্যে এর অনেকগুলো ব্যক্তি মালিকানায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেগুলোরও বেশ কয়েকটা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।
কোনো দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধি বা মাথা উঁচু করে বেড়ে ওঠার মূল ভিত্তি হচ্ছে শক্তিশালী জাতীয় পুঁজি। আর এই জাতীয় পুঁজি গড়ে ওঠে কেবল নিরবচ্ছিন্ন শিল্পায়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ যে দেশ যত শিল্পোন্নত সে দেশের জাতীয় পুঁজি ততো সংহত, অর্থনীতি ততো শক্তিশালী। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিমে সামন্ততন্ত্র হটিয়ে যে শিল্প বিপ্লবের শুরু তারই ধারাবাহিকতায় আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কালেক্রমে এরাই হয়ে ওঠে শিল্পোন্নত দেশ। এমনই কয়েকটা দেশ মিলে ১৯৪৪ সালে গঠন করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক। আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এরই একটি শাখা। গোড়াতে নিজেদের মধ্যে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য থাকলেও সত্তরের দশক থেকে স্বল্পোন্নত বা গরীব দেশগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ সহায়তার কর্মসূচী নেয়। একেবারে বিনা মতলবে না। এই ঋণদানের সুবাদে তারা বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিতে থাকে। অর্থনীতিতে নাক গলিয়ে চলে এবং একপর্যায়ে বাজার অবারিত করে দিতে বা মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণে বাধ্য করে। এই সুযোগে নিজেদের দেশের শিল্পপণ্য রপ্তানি করতে থাকে। স্বল্পশিক্ষিত অর্ধসভ্য অভাবী দেশের সরকার বা ব্যবসায়ী সমাজের কোন দেশপ্রেম থাকে না। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অবাধ আমদানির মাধ্যমে এরা দেশকে করে তোলে ভিনদেশের পণ্যের বাজার। এভাবে গরিব দেশগুলোয় স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির কবর রচিত হয়।
এই শিল্পোন্নত দেশগুলো যে লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিল একপর্যায়ে দেখা যায় এই নীতি বুমেরাং হয়ে তাদের ওপরই ফিরে এসেছে। চায়না তাদের রাষ্ট্রীয় নীতির গ্রেট ওয়াল ভেঙে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহন করে সবাইকে বিপদে ফেলে দেয়। কম দামে পণ্য বেচে সারা দুনিয়ার মার্কেট নিজেদের করায়ত্ব করে নিয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো এই প্রতিযোগিতায় একেবারে ধরাশায়ী। উচ্চ মজুরির কারণে তাদের উৎপাদিত শিল্প বা কৃষিজাত পণ্যের দাম চায়নার পণ্যের চেয়ে বেশি। এ ধরনের পণ্য অন্য দেশে গছানো দূরের কথা নিজেদের দেশেও বিক্রি করতে পারছে না। মানুষও সস্তায় চায়নার মাল কিনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বেশি দামে দেশি পণ্য কিনতে আগ্রহী নয়। ফলে কিছু ভারী শিল্প বাদে ছোট বা মাঝারি শিল্প কারখানাগুলোর হালে করুণ দশা। রাষ্ট্রীয় খরচ যোগাতে মোড়ল দেশগুলো এখন নানা জায়গায় যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায় নেমেছে। চায়না এখন এক ইকোনোমিক জায়ান্ট। না পারা যাচ্ছে চায়নাকে ঠেকাতে, না নীতি বদলাতে। বলতে গেলে ওয়ার্ল্ড কনজ্যুমার মার্কেট এখন পুরোটাই চায়নার দখলে।
কিন্তু এই মুক্তবাজার নীতি সর্বনাশটা করে গেছে ছোট ছোট গরিব অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর। যেসব দেশে গণতন্ত্র জবাবদিহিতা বা আইনের শাসন আছে, রাজনীতিকরা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ বা সরকার দেশপ্রেমিক, এমন কিছু ব্যতিক্রমী দেশ এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। পাশের দেশ ভারত জন্মলগ্ন থেকে ব্যপক শিল্পায়নের মাধ্যমে স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে। দেশীয় শিল্পের প্রটেকশন দিতে দুইএকটা অতি জরুরি পণ্য বাদে দীর্ঘকাল যেকোনো ধরনের বিদেশি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে রাখে । কিন্তু ১৯৯১ সালে ড. মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হলে অর্থনীতিতে কিছু সংস্কারসাধন করেন। রাষ্ট্রীয় খাতের কিছু শিল্প কারখানা বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেন, বিদেশি পুঁজি আকৃষ্ট করতে কয়েকটি খাত উন্মুক্ত করে দেন, স্বল্প পরিসরে বিদেশি পণ্য আমদানির পথ খুলে দেন। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুরোপুরিভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেন। অবশ্য ততোদিনে তাদের জাতীয় অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে এই নীতি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে নাই। তারপরও যে চায়নার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক তাদের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক করতে এবং ধরে রাখতে হয়েছে। ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ওই বছর ভারত চায়না থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের মালামাল আমদানি করেছে পক্ষান্তরে রপ্তানি করেছে মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমাদের দেশে স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা কমই হয়েছে। প্রকৃত দেশপ্রেম যথাযথ বা বাস্তব জ্ঞান এবং দূরদর্শিতা না থাকায় সরকারগুলো শুধু তাৎক্ষণিকতায় ভুগেছে। নগদ লাভের আশায় জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। দেশ এখন বিদেশি পণ্যের স্বর্গরাজ্য। কোনটা রেখে কোনটা বর্জন! ৩-৪-২৪। ফেসবুক থেকে