ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ ১৮ কোটি ডলার কমেছে
সোহেল রহমান : [১] চলতি পঞ্জিকা বছরের গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ আরও ১৮ কোটি ডলার কমেছে। এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ কমেছে ৭০ কোটি ডলারেরও বেশি।
[২] ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলারের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, টাকার মান কমে যাওয়ার শঙ্কা, ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমে যাওয়াসহ নানান কারণে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমেছে।
[৩] কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারি মাসে বেসকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০৭ কোটি ডলারে।
[৪] গত ২০২২ সাল শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার, অর্থাৎ ১৪ মাসের ব্যবধানে এটি ৫৩৪ কোটি ডলার বা ৩৩ শতাংশ কমেছে।
[৫] জানা যায়, বিদেশি উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের জন্য তহবিল ঋণ নেয়াকে স্বল্পমেয়াদী ঋণ হিসেবে ধরা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য আমদানিকারকরা বিদেশি ঋণদাতাদের থেকে ঋণ নেন, যা বায়ার্স ক্রেডিট নামেও পরিচিত। আমদানি দায় পরিশোধে ব্যাংকগুলোও বিদেশি উৎস থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে থাকে। বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফার্ড পেমেন্ট, ফরেন ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি, স্বল্পমেয়াদী ঋণ এবং অন্যান্য স্বল্প মেয়াদী দায়ের আউটস্ট্যান্ডিং ফিগার যোগ করে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ হিসাব করা হয়।
[৬] কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বায়ার্স ক্রেডিট। ২০২২ সাল শেষে ৯৫৭ কোটি ডলার থেকে কমে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এর আউটস্ট্যান্ডিং দাঁড়িয়েছে ৫৭৭ কোটি ডলার। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসেও এটি প্রায় ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার কমেছে।
[৭] ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, যারা বায়ার্স ক্রেডিট দেয় এবং এই ধরনের স্বল্পমেয়াদী ঋণ যারা নিচ্ছে, তাদের দু’পক্ষের আগ্রহ কমার কারণেই বায়ার্স ক্রেডিটের আউটস্ট্যান্ডিং কমেছে।
[৮] বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহক ব্যাংকের পক্ষ থেকে বায়ার্স ক্রেডিট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের রিজার্ভ আগের তুলনায় অনেক বেশি কমে যাওয়ায় তারা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় ব্যাংকগুলোকে খুব বেশি ভরসা করতে পারছে না। এছাড়া, বেশকিছু গ্রাহক ও ব্যাংক ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ডলার সংকটসহ নানান কারণে এসব ঋণ সময়মতো পরিশোধ করেনি। এ কারণে তারা ঋণ দেয়া আগের তুলনায় কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
[৯] অন্যদিকে গ্রাহকেরা এখন ঋণ নিলে ছয়মাস পর কত পরিশোধ করতে হবে, সেটি তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না। কারণ, এক্সচেঞ্জ রেট রিস্ক, ইন্টারেস্ট রেট রিস্কসহ অনেকগুলো বিষয় তাদের বিবেচনায় নিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে নতুন ঋণ যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে তারচেয়ে বেশি। এ কারণেও স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ঋণ কমছে।
[১০] কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশি ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) ৩.৫ শতাংশ, যা এখন বেড়ে ৫.৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আগে একটা সময় এই হার ১ শতাংশের নিচে ছিল। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এমন উচ্চ সুদহারে ঋণ নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে ঋণগ্রহীতারা। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো দ্বারা অরিতিক্ত চার্জ আরোপের কারণেও এ ধরনের ঋণ কমে এসেছে।
[১১] এসওএফআর হলো আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ঋণে সুদহার নির্ধারণের একটি বেঞ্চমার্ক। এটি লন্ডন ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জের প্রতিস্থাপক হিসেবে কাজ করে।
[১২] এদিকে, গত বছর দুয়েকের মধ্যে টাকার মান অনেক কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। আগামী ছয়মাস পর টাকার মান আরো কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এর আগেও টাকার মান কমার কারণে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীরাও এখন ঋণের বদলে সাইট পেমেন্ট করার দিকেই বেশি আগ্রহী বলে জানা যায়।