ইরানের এআই ইমেজ যা অক্ষমতার জ্বালা লাঘব করেছে
পারভেজ আলম
ইরানের অগনিত উড়ন্ত ড্রোন আসমান ঢেকে ফেলেছে, এগিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে। নিচে ইজরাইলের নগরগুলার কল্পিত ধ্বংসস্তুপ, অনেকটা গাজার বাস্তব ধ্বংসস্তুপের মতো। এটা একটা এআই ইমেজ, যা ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে আবেগ প্রকাশ করছেন। গাজার জনগণের জন্যে কিছু করতে না পারার অক্ষমতার জ্বালা লাঘব করছেন।
কী বলবেন এই এআই ছবিকে? এজিয়ান সাগরের বুক ভেদ করে ট্রয় নগরীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকা সহস্ত্র গ্রিক রণতরির যেই ছবি এঁকেছিলেন হোমার তার এলিয়াডে, সেই ছবিরই একবিংশ শতকী এআই সংস্করণ? প্রাচীনকালে একটা বাস্তব যুদ্ধ বা সংঘর্ষ বা হিজরতের কাহিনী কিংবদন্তি বা মিথে পরিণত হইতো একটু একটু করে, কয়েক শতাব্দি ধরে। এআইয়ের আমলে বাস্তব যুদ্ধকে মিথ বানাইতে একদিনও লাগে না। কিন্তু কোন যুদ্ধের মিথ এই ছবিটা? ইরানের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলার? নাকি তাদের ভবিষ্যতের কোন আকাঙ্খিত যুদ্ধের (নিচের ধ্বংসস্তুপ দেখে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক)? আদতে, এই ছবি না অতীতের, না ভবিষ্যতের। এ হলো এক হাইপাররিয়েল ছবি। একটা স্পেক্টাকল। এই ছবির মধ্যে বাস্তবকে এমনভাবে ছবিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে, ছবিগুলাই বাস্তব হয়ে গেছে। আর বাস্তব, আহা বাস্তব – কোথায় তোমার ঘর? এই ঘোর ডিজিটাল জমানায়?
এই ছবিকে আপনি এআই পৌত্তলিকতাও বলতে পারেন। মাহদিয় বিপ্লবী রূহকে পুরোততান্ত্রিক রাষ্ট্রক্ষমতার মধ্যে, বিধানের মধ্যে, নারী বৈষম্যের মেকানিজমের মধ্যে গ্রেফতার করলে যা হয়, সেটাই হয়েছে ইরানে। গত এক দশকে রাষ্ট্রটি নিজের দেশের মানুষের উপর হেজিমনি বজায়ে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজেদের হাজির করেছে অন্যতম সামরিক শক্তি হিসাবে। বহুক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যের মজলুমদের পক্ষে দাঁড়াবার নামে তারা মজলুমদের আরো ক্ষতি করছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলার পুঁজিপতি ও সামন্ততন্ত্রী শাসক শ্রেণীর স্বার্থপ্রতার কারনে তারা নিজেদেরকে এখনো উপস্থাপন করতে পারে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী শক্তি হিসাবে। কিন্তু এইসব শো-অফ, বাস্তবতাকে ইমেজে পরিণত করার পৌত্তলিকতা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নাই আজকাল। মাহদিয় রূহকে মানুষ ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিশুদ্ধ স্পেক্টাকল ও আইনি কাঠামোর মধ্যে গ্রেফতার করলে তা পরিণত হয় জুলুমের যন্ত্রে। একটা সম্ভাবনাময় সমাজকে তা ভেতর থেকেই পচিয়ে ও ধ্বসিয়ে ফেলে। এআই ছবিটিকে তাই আপনি ইরানের বাস্তবতা হিসাবেও পাঠ করতে পারেন। নিচে পড়ে আছে বিপ্লবের ধ্বংসস্তুপ, উপরে উড়ছে কাল্পনিক জয়রথ।
দাজ্জালি শক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে তা মিথ্যাকে সত্য হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে, আর পাবলিক সহজেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। জেনেশুনেও মিথ্যাকে সত্য হিসাবে গ্রহণ ও উদযাপন করে। ওয়াল্টার বেনিয়ামিন যথার্থই বলেছেন যে অতীতের ধর্মগুলা আর যাই হোক, অন্তত মানব স্বভাব ও সমাজের সবচয়াইতে মনস্ট্রাস কিছু অবতারকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ভবিষ্যতে এসব অবতার কোনদিন প্রকাশ পেয়ে যাবে, এই সাবধানবানী ছিল এসব শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখার অন্যতম উপায়। দাজ্জালের কাহিনীও তেমনই একটি সাবধানবানী ছিল।
বেনিয়ামিনের মতে, পুঁজিবাদী দুনিয়া বলতে আমরা যেই দুনিয়াকে চিনি, তা সেই মনস্টার অবতারদেরই দুনিয়া, যাদের ব্যাপারে আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের সাবধান করেছিল। দাজ্জালি শক্তিগুলাতো অবশেষে নিজেদের উন্মোচন করেছে। কিন্তু আপনি কি তাদের চিনলেন? না যদি চেনেন, তবে এতো মাহদি ও দাজ্জালের হাদিস পড়ে লাভ কী হলো? লেখক: নেদারল্যান্ড প্রবাসী গবেষক।