ব্যাংক একীভূতকরণ : দুর্বল ও সবল ব্যাংক
কাজী এম. মুর্শেদ
আপাতত যা বুঝেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ বলতে এক্যুজিশন বোঝাচ্ছে। আমি দুইটা টার্ম আগেই ব্যাখ্যা করেছিলাম। একটা মার্জার বা একীভূতকরণ, অন্যটা এক্যুজিশন বা অধিগ্রহণ। দুইটা টার্ম আলাদা, কাজ করে আলাদাভাবে। মার্জার হলে দুই ব্যাংক একত্রে বসে মালিকানা নির্ধারণ করে, মালিকানা অর্থ। [১] স্পন্সর শেয়ার হোল্ডার কারা। [২] ইনস্টিটিউশনাল শেয়ার হোল্ডার কারা। [৩] পাবলিক অফারিং কতো আছে। এরপরের ধাপে শেয়ার ভ্যালু নির্ধারন করে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার হাতে রেখে প্রথমে ইন্সটিটিউট শেয়ার হোল্ডারদের শেয়ার ঠিক করা হয়, শেষে পাবলিক অফারিং ঠিক করা হয়। মার্জার তেমন জটিল প্রক্রিয়া নয়, তবে দুর্বল শেয়ারের দাম কিছু বাড়ে, সবল শেয়ারের দাম কমে একই জায়গায় নিয়ে আসতে হয়। অনেকেই তাড়াহুড়া করে সবল শেয়ার বিক্রি করে ফেলে। সেটা না করে ধৈর্য্য ধরা ভালো।
বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে তা মূলত এক্যুজিশন, কিন্তু এখানে বাংলায় অধিগ্রহণ না বলে একীভূতকরণ কথাটা ব্যবহার করছে। এক্যুজিশন তুলনামূলক সহজ ব্যাপার, দুর্বল ব্যাংকের শেয়ার পুরোটাই কিনে নেওয়া হয়। সবল ব্যাংক চাইলে বোর্ডে কাউকে রাখতে পারে, নাও রাখতে পারে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা, দুর্বল ব্যাংকের স্পন্সর ডিরেক্টররা অন্য কোনো ব্যাংকে পাঁচ বছরের মধ্যে বোর্ডে থাকতে পারবে না। এটা কোনো নীতিমালায় থাকা উচিত ছিলো না। একইসঙ্গে সেই ব্যাংকের এমডি, ডিএমডি সবাই চাকরি হারাবে। এটাও খুব ভালো পদক্ষেপ নয়। অনেক যোগ্য স্পন্সর ডিরেক্টর ও এমডিরা চাকরি হারানো মানে সংবিধান লংঘন করে মানুষের মৌলিক অধিকার, জনগণের কাজ করার স্বাধীনতা ভঙ্গ করা।
বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের নামে যে ঘটক রাখা ভাই বা প্রজাপতির আখড়া খুলে বসেছে, সেটার মধ্যে দুইটা জিনিস পাইÑ এক হলো জবরদস্তি করে কাকে কিনতে হবে। আর দুই এর চেয়েও দুর্বল ব্যাংক আছে, সেগুলোকে ছাড় দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের লিস্ট থেকে এই নয় বিবাহযোগ্যা কনে হলো, [১] পদ্মা ব্যাংক, যাকে এক্সিম ব্যাংক নিচ্ছে। [২] রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, যাকে কৃষি ব্যাংক নিচ্ছে। [৩] বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, যাকে সোনালী ব্যাংক নিচ্ছে। [৪] বেসিক ব্যাংক, যাকে দ্য সিটি ব্যাংক নিচ্ছে। বাকি পাঁচ পাত্রীর জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে! [ ১] এবি ব্যাংক লিমিটেড, [২] ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড [৩] ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড [৪] সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এ্যন্ড কমার্স ব্যাংক [৫] ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে বেশ কিছু ব্যাংক যাঁদের ব্যাংকিং ক্রাইটেরিয়াতে ভালো অবস্থন নাই তারা কেউই এই তালিকায় নাই। আমি নাম বলতে চাই না, এর কারণ হলো, আপনারা যারা শেয়ার ব্যবসায় আছেন তারা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একেই গত নয় মাসে শেয়ারবাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, আরো মানুষ রাস্তায় নামুক চাই না। এ ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্য কোনো রিপোর্ট হয় না, হলেও প্রকাশ হয় না। সেখানে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন সফলভাবে এই কাজ সম্পন্ন করতে পারায় ৮ এপ্রিল পুরস্কার হিসেবে চেয়ারম্যানের চাকরির মেয়াদ নবায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটা সূচক দাঁড় করিয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে হিসাবনিকাশ করা হবে। এগুলো হলোÑ[১] ক্যাপিটাল এ্যভেইলেবল রেশিও [২] ক্যাপিটাল রেশিও [৩] কমন ইক্যুইটি রেশিও [৪] এ্যকচুয়াল ব্যাড ডেব্ট [৫] গভরনেন্স। যে সূচক দেখছেন, এটা কি যথেষ্ট? প্রথম তিনটা অবজেক্টিভ বা হিসাব করলে বের হয়। চতুর্থটা ইচ্ছা করলেই ম্যানিপুলেট করা যায়, যেমন লোন রিস্কেজুল করা বা অতিরিক্ত লোন দিয়ে আগের লোন শোধ করা। পঞ্চমটা পুরাই সাবজেক্টিভ। বিভিন্ন ধরনের হিসাবপাতি করতে হয় এরপর কোনটা সবল ব্যাংক কোনটা দুর্বল ব্যাংক তা হলা যায়। একদম সাধারণ দৃষ্টিতে চিন্তা করেন, নিজেকে একজন আমানতকারী এবং শেয়ার ব্যবসায়ী হিসাবে ভাবেন কী কী সূচক থাকা উচিত, সেটা এ্যানুয়াল জেনারেল মিটিংয়ের প্রিন্টেড অডিটেড রিপোর্টেই পাবেন। আমি সাধারণভাবে কয়টা হিসাব বলি।
[১] ব্যাংকের লিক্যুইডিটি অবস্থা কেমন, আমি টাকা রাখলে পাবো কিনা। [২] গ্রস নন-পারফরমিং এসেট কতো, ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ দিতে সক্ষম কিনা।
[৩] নিট নন পারফরমিং এসেট কতো, ব্যাংকের কতো টাকা ব্যাড ডেব্ট হিসাবে ধরা হচ্ছে। [৪] প্রভিশন কাভারেজ রেশিও কতো, ব্যাড ডেব্ট কাভার করার জন্য প্রফিট থেকে প্রভিশন রাখা আছে কিনা, [৫] ক্যাপিটাল এডেকোয়েসি রেশিও, মূলধন যা আছে তা দিয়ে বিভিন্ন লায়ৈবিলিটি কাভার করতে সক্ষম কিনা। [৬] কারেন্ট একাউন্ট সেভিংস একাউন্ট রেশিও, সংখ্যা কম মানে বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে আটকে যেতে সারে। [৭] ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও, ব্যাংক ঋণ দেবার সময় কতোটা নিজস্ব আমানতের উপর ভরসা করবে, নাকি অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করে ঋণ দেবে। [৮] নিট ইন্টারেস্ট মার্জিন, লেন্ডিং রেট আর ডিপোজিট রেটের পার্থক্য বা শতকরা কতো টাকা ঋনে সুদ পায় আর আমানতকারীদের সুদ দেয় সেই পার্থক্য। [৯] রিটার্ন অন এ্যাসেট, ব্যাংকের প্রফিটেবিলিটি কেমন নতুন রেভিনিউ জেনারেট করতে।
এসবই সাধারণ সূচক, সবই অবজেক্টিভ বেইজড। জনগণের মাঝে যে ধারণা জমে বা খারাপ অভিজ্ঞতা বা মিডিয়ায় খারাপ কাভারেজ সেসব অন্য ব্যাপার। সেসব সাব্জেক্টিভ ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা না করলেও একটা ব্যাংক বিচার করতে সেগুলোও কাজ করে। আপনি নিজের মতো সূচক বা ইনডেক্স নিয়ে কাজ করেন। নিজেই বুঝবেন কোনটা দুর্বল ব্যাংক, কোনটা সবল ব্যাংক। কোনোটা মূলত দুর্বল হলেও আপাতত তাদের নাম রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চারণের ক্ষমতা নেই। এরপর কোন ব্যাংকে কোনটা একীভূতকরণ করা হবে জানা নেই, তবে খবর যা শুনেছি, বেসিক ব্যাংককে নেবার জন্য সিটি ব্যাংক সম্ভবত বড় ধরনের সরকারি সহায়তা পাবে। এই ধরনের স্বল্পমেয়াদী গেইমপ্লান ভালো নয়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ন্যাশনাল ব্যাংক, যাঁদের বিশেষ একটা গ্রুপের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যাড ডেব্ট দেখাতে বলা হয়েছিলো। ফলাফল পুরো দোষ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ও ম্যানেজমেন্টের ওপর চাপানো হয়। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক