ঋণ ফেরত প্রক্রিয়া আরও নমনীয় করার সুযোগ কি আছে?
ড. সেলিম জাহান
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তথ্যানুসারে যে মজুদ বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে তা যদি আরো কমে আসে তাহলে আমদানির ওপর চাপ পড়বে। আমাদের বহু জিনিস আমদানিনির্ভর
। আমরা যদি জ্বালানি তেলের কথা বলি, পরিবহন খাত থেকে শুরু করে আমাদের শিল্প, এসব কিছু জ্বালানির ওপর নির্ভর। সুতরাং এ মজুদ কমে এলে আমাদের আমদানি ক্ষমতা কমে আসবে। সেটার বিরূপ একটা প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে পড়ছে। কিছু জায়গায় এ ব্যাপারে নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। একটা হলো আমদানির ক্ষেত্রে। যেসব আমদানি আমাদের উৎপাদন কিংবা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো অব্যাহত রাখা এবং অন্য যেসব আমদানি আছে সেগুলো কমিয়ে ফেলা। তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ সেটার ওপর চাপ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, রফতানি কীভাবে বাড়ানো যায় সেটি বিবেচনা করা দরকার। কারণ রফতানি না বাড়লে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ তার সরবরাহ বাড়বে না। আর এ রফতানি বাড়ানোর জন্য আমরা যেসব দেশে রফতানি করে থাকি, তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এটাকে আরো নানা দিক থেকে বাড়ানো যেতে পারে কিনা বা রফতানি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে কিনা। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বা বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে ঋণ নিয়েছে, সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা যে দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেÑতাদের ঋণ ফেরতের প্রক্রিয়াটি আরো নমনীয় করা যেতে পারে কিনা। অথবা এটাকে আরো দীর্ঘায়িত করা বা এটাকে ধাপে ধাপে দেয়া যায় কিনা সেটি আলোচনার মধ্যে আনতে হবে। তাহলে আমরা বলতে পারি যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের সংকটের চাপটা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারব।
আমি প্রশ্নটাকে একটু ব্যাপ্ত করি, প্রশিক্ষণের বাধা সেটা অবশ্যই একটা বড় বাধা। শ্রমবাজারের সর্বস্তরের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। তবে আমি শুধু প্রশিক্ষণের মধ্যে এ আলোচনাকে রাখতে চাই না। দক্ষ মানবসম্পদের একটা বড় অংশ আসে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা এ বিভিন্ন স্তরে যারা পড়াশোনা করছেন ও যারা পড়াচ্ছেন তাদের দুটো দলই সনদ পাওয়া এবং দেয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে এ শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কী শিখছি এবং কতটুক দক্ষতা অর্জন করলাম সে ব্যাপারে আগ্রহ কম। আবার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষা পদ্ধতিরও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে কারিগরি মাধ্যম থেকে যারা বের হচ্ছে তারা সেভাবে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছে না। সেজন্যই দেখা যায় যে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকরা ন্যূনতম কারিগরি দক্ষতাও উপস্থাপন করতে পারে না। অর্থাৎ সনদপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও যে দক্ষতা থাকার কথা সেটা আমরা তাদের থেকে পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে বলা যায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ত্রুটি রয়েছে সেটা দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। কারণ আমরা যতই প্রযুক্তিনির্ভর হই না কেন আমাদের কিন্তু মানবসম্পদ লাগবেই। তাই আমি বলব, এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে দক্ষতার সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে তৈরি করতে পারবে। এটা হচ্ছে অন্তরায়ের প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যখন একজন শিক্ষার্থী শ্রমবাজারে ঢুকছেন প্রথমেই তিনি যে বিষয়টি টের পান সেটা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত নয়। একজন শিক্ষার্থী যে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করছেন তাকে সেখানে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদেরও প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ কম, আবার যারা শিখবে তাদেরও শেখার আগ্রহটা কম থাকে। পৃথিবী প্রতিনিয়তই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি প্রযুক্তিও বদলাচ্ছে, উৎপাদনের প্রক্রিয়াও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে যদি আমরা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানের মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হব। বর্তমানে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন হলেও কেন্দ্রগুলোয় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। দেখা যায়, সেখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি থাকে না অথবা ভালো প্রশিক্ষকেরও ঘাটতি থাকে অনেক জায়গায়। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোরও যোগাযোগ প্রয়োজন যাতে প্রতিষ্ঠানের চাহিদার আলোকে মানবসম্পদ তৈরি হয়। অন্যথায় আমরা চাহিদার আলোকে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারব না। তবে কোনো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে মানবসম্পদের এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রকৃত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণয়ন করতে হবে। সেটি না করে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে সেটি কতটুকু কাজে আসবে তা তো প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী এখন আমাদের উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যদি আমরা আমাদের জনশক্তি দিয়ে শূন্যতা পূরণ করতে না পারি তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে।
খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কতগুলো নির্ণায়ক থাকে এর মধ্যে একটি হচ্ছে, এখান থেকে আমরা উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করতে চাই। সেক্ষেত্রে আমাদের ভাবা দরকার মূলত কতসংখ্যক এমন দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন এবং এ সংখ্যক জনশক্তি সরবরাহ করতে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে দক্ষ জনসম্পদের যে চাহিদা তাতে ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনগুলো এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে হয়। স্থানীয় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আনুকূল্য দেয়ার জন্য স্থাপিত হয়। এটি বস্তুনিষ্ঠ কোনো নির্ণায়ক হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এভাবে গণহারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় তাহলে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির বদলে ভুল জায়গায় অর্থ বিনিয়োগ হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এখান থেকে যারা বের হবে তাদের আমরা দক্ষভাবে তৈরি করতে পারব না। যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা সনদ দিয়ে বের করব, তাদের আমরা বেকার জনশক্তি হিসেবে তৈরি করব। কারণ তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ, চাকরি বা কাজ আমাদের হাতে নেই। সুতরাং সে জায়গায় একটা বড় সমস্যা দেখা দেবে। এটা না করে উচ্চতম পর্যায়ে বিশেষত ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাতে মনোযোগী হতে হবে। প্রতি বছর আমাদের কতজন উচ্চতম দক্ষ মানুষের প্রয়োজন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে? সেই অনুপাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঢেলে সাজানো হয় তাহলে আমাদের যে প্রয়োজন সেটা মিটবে। কারিগরি, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সেখানেও ঠিক একইভাবে যদি আমরা মূল্যায়ন করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করি তাহলে সেটা হবে। বর্তমান পর্যায়ে ঢালাওভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে আর্থিক অপচয় হচ্ছে। আমাদের দেশে আর্থিক অপ্রতুলতা রয়েছে। এ সম্পদগুলো অন্য জায়গায় ব্যবহার হতে পারত। যেমন স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যবহার হতে পারত, সেটা হচ্ছে না।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র