আমরা কি গার্মেন্টস আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকব
ড. মাহবুবউল্লাহ
একাত্তরের আগে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কাজের প্রতি উদ্যম কম ছিলো। বেশির ভাগ মানুষ ভাবতো কীভাবে সরকারি চাকরি করে মধ্যবিত্ত জীবন-যাপন করা যায়। উচ্চাকাক্সক্ষা ছিলো না তাদের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দুরন্ত আশা কবিতায় বলেছেন, অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব। অর্থাৎ বাঙালিরা এতোই অলস যে, তারা ভাত চিবিয়ে খায় না। অন্নপায়ীদের মতো ভাত না চিবিয়ে গিলে খায়। আর স্তন্যপায়ী জীবদের মতো তারা থাকে। পরিশ্রম করতে, কষ্ট করতে ও ঝুঁকি নিতে চায় না। আকাক্সক্ষাকে উদ্দেশ্য করেই রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় আরো বলেছেন, ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুঈন। অর্থাৎ বেদুঈনের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, তারা দুঃসাহসী। তারা মরুভূমির মতো জায়গা যেখানে ফসল হয় না, খাদ্য পাওয়া যায় না সেখানে জীবনযাপন করে। তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয় বহু ঝুঁকি নিতে হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী আমরা যে বাংলাদেশ দেখলাম, সেটা হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের যে মাইন্ড সেট সেই মানসিক গঠনের পরিবর্তন হয়ে গেলো এবং তারা ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে, নতুন কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এটা একটা জাতীয় চরিত্রে উঠে আসলো। দুর্নীতি কার সঙ্গে এসেছে, কীভাবে এসেছে এসব অন্য বিষয়। স্বাধীনতার পর বিশাল এ পরিবর্তন দেখলাম এরপর থেকেই দেখলাম অনেকেই উদ্যোগ নিয়ে শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে নানা কিছু তৈরি করছে। উদ্যোগ নেওয়া মানে কেবল শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে তা নয়, একজন গ্রামের কৃষক যে তার জীবনকে সুন্দর করার জন্য, ফসল ফলানোর জন্য কাজ করে সেও কিন্তু একজন উদ্যোক্তা। আজকে বাংলাদেশ যে কৃষিখাতে রূপান্তরিত এখানে কেবল ধানের উৎপাদন হয় না, আরও অনেক ধরনের ফসল হয়। পাশাপাশি উচ্চমূল্যের সবজিও আবাদ করা হচ্ছে। এখানে ফুল ও ফলের চাষ হচ্ছে, হাঁস-মুরগির খামার হচ্ছে নানা কিছু হচ্ছে।
স্বাধীনতার সময় আমাদের লোকসংখ্যা ছিলো সাড়ে সাত কোটি। এ সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য জোগাড় করতে আামাদের অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। তখন দুর্ভিক্ষ হয়েছে। কিন্তু আজ চতুর্থ বিশ্বের মধ্যে খাদ্য এবং খাদ্যের মধ্যে নানা রকমের জিনিস আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। তবুও আমরা বলি দেশে খাদ্য সংকট হচ্ছে আবার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হয়। এই যে প্যারাডক্স এটা থেকে কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখতে হবে যে দেশে উৎপাদনের অর্জন ও কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে কিনা তার সঠিক পাওনাটা সে সঠিক সময়ে পাচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দুটো জিনিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে এক. কৃষি এবং দুই. আমাদের দেশের মেহনতি মানুষ যারা বিদেশে যায় এবং রেমিটেন্স পাঠায়। জেনারেল জিয়ার সময় বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্সের বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো এবং পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ব্যাপকভাবে বিদেশে যাওয়ার জন্য মানুষ লাখ লাখ টাকা খরচ করছে। এখনো দেখা যাচ্ছে দালালের দ্বারা তারা প্রতারিত হচ্ছে অনেকের লাশ ভূ-মধ্যসাগরে পাওয়া যায়। সব সময়ই মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আমাদের দেশের মানুষের লাশ পাওয়া যায়। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানুষ জীবন-জীবিকা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ খুব কম মজুরির বেতনে কাজ করে সঞ্চয় করে তাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য, দেশের রেমিটেন্সের জন্য তারা টাকা-পয়সা পাঠায়। এটা আরও শক্তভাবে হতে পারতো যদি আমরা দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারতাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় গত ৫৩ বছরে ব্যাপকভাবে আমরা রেমিটেন্সের ওপরে নির্ভরশীল। আমরা দেশ থেকে আরও কিছু অর্জন করতে পারতাম যদি দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই এমনকি প্রাইভেট সেক্টরও তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আমি মনে করি প্রাইভেট কোম্পানিদের দায়িত্ব বেশি। তারা যদি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
বিশ্ববাজারের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এখন বড় প্রশ্ন হলো, আমরা কি কেবল গার্মেন্টস আর রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো? আমাদের দেশে শুধু গার্মেন্টস শিল্প করলে হবে না, অন্য শিল্পও করতে হবে। বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা সে দিক থেকে আমরা লেদার শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি করতে পারি, যদিও টেক্সটাইল কাঁচামাল। তুলা বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। এছাড়াও বহু রকমের ভোগ্যপণ্য হচ্ছে, বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র তৈরি হচ্ছে। সঠিক পলিসি ও পরিবেশ থাকলে সবই অর্জন করা সম্ভব, শিল্পায়ন করা সম্ভব এবং সেবা খাতকে সমৃদ্ধায়ণ করা সম্ভব, আমাদের রেমিটেন্স খাতকে আরও উন্নত করা সম্ভব। আমাদের দেশে সবকিছুই সম্ভাবনাময়। কিন্তু গত ৫৩ বছরে যেমন হওয়ার কথা ছিলো তেমন কিছু হয়নি। আমরা দেশে বেশকিছু পরিবর্তন দেখতে পাই। কিন্তু তা দুর্নীতির কারণে দুর্বল প্রশাসন ব্যবস্থার কারণে ভালো নীতি ও নৈতিকতার অভাবে আমরা তেমন কিছুই অর্জনে সফল হতে পারিনি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ। মুঠোফোনে মতামত গ্রহণ করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম