বাংলাদেশিরা একটা জীবন কাটিয়ে দিই কে কী বলবে, তা ভাবতে ভাবতে
আমিনুল ইসলাম
গত শতাব্দীর শেষ দশক। সালটা ১৯৯৮ হবে হয়তো। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছি। মামুন স্যার আমাদের সামাজিক পরিসংখ্যান কোর্সটা পড়াতেন। উনার কোর্সে আমি বেশ ভালো করেছিলাম। স্যার আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। সেবার ডিপার্টমেন্ট থেকে পিকনিকে গিয়েছি। স্যারও সাথে গিয়েছেন। খেয়াল করলাম রান্না, খাবার এসব বিষয়ে স্যারের ভীষণ আগ্রহ। ২০০৫ সালে যখন সুইডেনে গেলাম আরেকটা মাস্টার্স করতে। মামুন স্যারও একই ইউনিভার্সিটিতে একই প্রোগ্রামে মাস্টার্স শেষ করে সেখানকার একটা রেস্তোরাঁয় শেফ হিসেবে কাজ করছেন।
এই মানুষটার কাছে যতবার গিয়েছি, ভীষণ আগ্রহ নিয়ে খাবার পরিবেশন করতেন। উনার ধ্যান-জ্ঞান সকল কিছু ছিল রান্না নিয়ে। অথচ তিনি কিন্তু তখনও সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে না ফিরে রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করবেন। কারণ এ কাজ করতেই তার ভালো লাগে। এমন না তিনি টাকার পেছনে ছুটছিলেন। যেহেতু রান্না করতে উনার অনেক আগে থেকেই ভালো লাগতো, তাই তিনি রান্নাকেই পেশা হিসেবে নিয়ে নিলেন। জানি না এখন তিনি কি করেন। তবে সুইডেন ছেড়ে আসার সময়ও উনাকে মনের আনন্দে রেস্তোরাঁয় কাজ করতে দেখেছি। আমার মামুন স্যারকে ভীষণ হিংসা হয়। লোকে কী বলবে। এটা উনি ভাবেননি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শেফের কাজ করছেন। বাংলাদেশের সমাজে এটা চিন্তাও করা যায় না। আশপাশের মানুষজন উনাকে নিয়ে নানান কথা বলত। অথচ তিনি এসব গায়ে না মেখে দিব্যি যে কাজ করতে ভালো লাগে। সেটাই বেছে নিয়েছেন।
সহকর্মী ওলগাকেও আমার ভীষণ হিংসা হয়। সাদা চামড়া, নিল চোখের আমার এই নারী সহকর্মী মাঝে মাঝে টিকটক টাইপ আজব সব ছোট ছোট ভিডিও বানায়। এসব দেশে কে কী বলছে এ নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। গবেষণা পদ্ধতির মতো জটিল কোর্স পড়ায় ওলগা। অথচ দিব্যি আজব সব ভিডিও বানিয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন বানাও? ভালো লাগে তাই! সোজা উত্তর। অথচ আমার হিংসে হলো। কেন হিংসে হলো? কারণ আমারও ছোট-খাটো এমন অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু মানুষ কী বলবে। হালকা হয়ে যাব নাতো! এসব ভেবে আর করা হয়ে উঠে না।
…দেশের একটা দ্বীপে এসেছি ঘুরতে। যে রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছি। সে রেস্তোরাঁর সামনে বসে থাকা ম্যানেজারের সাথে কথা হচ্ছিল। তো, কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ওর একটা পিএইচডি ডিগ্রি আছে! জিজ্ঞেস করলাম, পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তুমি এই দ্বীপে বসে রেস্তোরাঁয় কাজ করছ? হ্যাঁ করছি। তোমাকে খুব হিংসা হচ্ছে আমার। কেউ কিছু বলে না তোমাকে? কই না তো। পিএইচডি করতে ভালো লেগেছে এজন্য করেছি। এখন এ কাজ করতে ভালো লাগছে। সেজন্য এটা করছি। আবার অন্য কিছু করতে ইচ্ছা করলে করবো। ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, এই কাজ যদি আমি করি! তাহলে এ দেশে থাকা বাংলাদেশিরা এমনিতেই তিলকে তাল বানিয়ে কত শত গল্প বানায়। এরপর হয়তো মহাকাব্য বানাবে আমাকে নিয়ে, ‘আমিনুল ইসলামের মনে হয় কোনো যোগ্যতা নাই। এসব করে বেড়ায়! ছিঃ … মান ইজ্জত আর থাকলো না।’ এই টাইপ কিছু আরকি।
আমারা তো এমনই। অন্যরা কে কী বলছে সেটাও আসলে ব্যাপার না। আমার করুণা হয় নিজের জন্য এবং আমার ধারণা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ আমার মতোই। কারণ আমার সর্বক্ষণ মনে হয়, কেউ কিছু ভাবছে নাতো? হালকা হয়ে যাচ্ছি নাতো? আমরা বাংলাদেশিরা একটা জীবন কাটিয়ে দিই কে কী বলবে এটা ভাবতে ভাবতে। অনেক ইচ্ছা তো চাইলেও পূরণ করা যায় না। কিন্তু ছোট-খাটো এমন অনেক ইচ্ছা আছে, যেগুলো হয়তো পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু ওই যে, কে কী বলবে? এই ভয়ে আর হয়ে উঠে না। অথচ সেই একই সমাজে কেউ কেউ খুন, ধর্ষণ, ব্যাংক ডাকাতি কিংবা বিদেশে টাকা পাচার করেও দিব্যি হিরো হয়ে যাচ্ছে। আর মাস্টার্স পাস করা একটা ছেলে কিংবা মেয়ে যদি রেস্তোরাঁয় কাজ নেয়। তাহলে সেই একই সমাজ বলবে, এত পড়াশোনা করে কী লাভ হলো, এর চাইতে মরে যাওয়াও ভালো! সমাজ তো দূরে থাক! পরিবারের সদস্যরাই বলবে। ১২-৪-২৪। ফেসবুক থেকে