ওয়ালটনের পণ্য বর্জন আর যৌনতা বিষয়ক আবশ্যিক আলাপ
সায়েমা খাতুন
এক- কেবল সমকামিতাই নয়, যৌনতার আগাগোড়াই সব সমাজের জন্যে একটি অগ্নিগর্ভ আলোচ্য বিষয়। যৌনের রাজনীতি সব রাজনীতির মাতৃগর্ভ। দৈহিক কামনা-বাসনার বস্তু হিসেবে যৌনতার আলোচনা যে পরিমাণ ডিসট্রাকশন সৃষ্টি করে, সেনসেশন তৈরি করে, লজ্জা বা অস্বস্তি উৎপাদন করে যে, তাতে এ বিষয়ে যে কোন বৈজ্ঞানিক, বা সমাজবৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক আলোচনা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এর উপর সত্যি সত্যি মানুষের বাঁচামরা নির্ভর করে। সমাজের বাঁচামরা, মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব, মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা, মানে আমার জাতির ডিএনএর নক্সা হাজার হাজার বছর ধরে বাহিত করা নির্ভর করে, আবার এখনকার সমাজের লোকবল সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রণ করার রহস্যও এরই মধ্যে নিহিত। আলাপটা ক্লিশে শোনালেও আবার না বলা থাকার উপায় নেই। বাঁচতে হলে আলাপটা করতেই হবে।
ইভোলিউশনারি পারস্পেক্তিভ থেকে দেখলে, হাজার হাজার বছর ধরে মানব সমাজগুলোর সারভাইভালের প্রশ্নের সাথে তাদের যৌন প্র্যাকটিসের রেগুলেশন একটা ভাইটাল বিষয় ছিল। যৌন নিষেধাজ্ঞাই মানব গোষ্ঠীগুলোকে গড়ে তোলে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সর্বজনীন ছিল অজাচার নিষেধাজ্ঞা। ফেরাউনদের মত দুই-একটা খুবই ইউনিক গোষ্ঠী ছাড়া প্রায় সব যুগের সকল মানব গোষ্ঠী পিতা-মাতা ও ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে, যাকে বলে অজাচার, কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভগ্নী বিনিময় প্রথা, মানে, এক গোষ্ঠীর পুরুষেরা নিজেরদের বোনদের অপর গোষ্ঠীতে বিয়েতে সম্প্রদান করে। নিজেরা বাইরের গোষ্ঠী থেকে কন্যা গ্রহণ করে। এই নারী বিনিময় খুব কঠোর রীতিনীতিতে পরিচালিত হত। সমাজভেদে নিজেদের গোষ্ঠীর ভেতরে অন্তর্বিবাহ, আবার বহিঃবিবাহসহ বিচিত্ররকম যৌন প্র্যাকটিস সমাজগুলো প্রচলন করে। মনগামি, পলিজিনি, পলিআন্দ্রি, শ্যালিকা-বিবাহ, দেবর-বিবাহ, ভুত-বিবাহ, শিশুদের বিবাহ এমন বৈচিত্র্যময় যৌনতার প্র্যাকটিস বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় এবং সময়ের দেখা গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, বিশ্বজুড়ে এই মডার্ন একগামী নারী-পুরুষের একক পরিবারই সম্ভবত পৃথিবীতে সবচাইতে কম সময় জুড়ে দেখা গেছে। এভলুশনের জায়গা থেকে এটি তেমন কার্যকর ব্যবস্থা ছিল না। তার মানে এই না যে, সভ্য হওয়ার কারনে নৈতিকতার মানদণ্ডে এখনকার চর্চাটাই সবচেয়ে উন্নত, আর বাদবাকিরা পিছিয়ে পড়া! বরং প্রতিটি সমাজের নৈতিকতার নিজস্ব মানদণ্ড ছিল এবং আছে, যা সকলকে মেনে চলতে হয়। এই যে যাবতীয় রকম যৌনতার চর্চার কথা শুনে যদি ভাবেন যে, এগুলো যার যা ইচ্ছা হল, তাই করলাম। ব্যাপারটা কখনই তেমনটা ছিল না। বরং, প্রত্যেকটি সমাজ তার যৌন ব্যবস্থাকে সমাজের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা সারভাইভাল সিস্টেম হিসাবে গণ্য করেছে, পাহারা দিয়েছে। অনুশাসনের মধ্যে রেখেছে। নতুন কোন প্রচলন আসলে সেগুলোকে নেগশিয়েট করেছে। যৌনতা সব সময়ই সমাজের অনুমোদন সাপেক্ষ বিষয় ছিল এবং আছে।
দুই-
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সন্তান লাভের একমাত্র উপায় হিসাবে বিষমকামী নর-নারীর সম্পর্কের গুরুত্ব মানব সমাজে অপরিসীম। ৬০০ কোটি মানুষের পৃথিবী এখন বুঝতে নাই পারে যে, বহু সন্তান জন্ম দেয়া এক একটা সমাজের বাঁচা-মরার প্রশ্ন, এই নিয়ে কোন ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ ছিল না। যে প্র্যাকটিস বেশী সন্তান পৃথিবীতে নিয়ে আসবে, সেই প্র্যাকটিসই সমাজগুলো অনুসরণ করতে চেয়েছে। তাই বহুগামিতা কখনই আজকের মত নিন্দনীয় ছিল না। কঠোর একগামি সমাজ আধুনিক পুঁজিবাদই আরোপ করেছে। যেহেতু নারী-পুরুষের মিলনই প্রজাতির পুনরুৎপাদনের একমাত্র উপায়, সমকামিতার চর্চাকে প্রশ্রয় দেয়া সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ারই নামান্তর। এই ট্যাবু বা নিষেধাজ্ঞাগুলোকে সমাজের সারভাইভালের জন্যেই আরোপ করা হয়েছিল। তবে এ-ও ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্ষমতা ও রাজনীতি, সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যেই যৌন আচারগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শাসক গোষ্ঠী ও শ্রেণিগুলো বরাবরই যৌন প্র্যাকটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে এবং এর কিছু না কিছু ব্যত্যয় সব সব সময়েই ছিল। তাই, যৌনতার কাজ কেবল কামনা-বাসনা মেটানোর চাইতে বৃহত্তর একটা বিষয়। কেবল বায়োলজিকাল তাড়না দিয়ে মানুষের যৌন চর্চাকে বোঝার কোন উপায় নেই। এটা সব সময়ই ংড়পরধষষু পঁষঃঁৎধষষু পড়হংঃৎঁপঃবফ। যে কারণের সেক্স থেকে জেন্ডার ধারনায় আসা, যেখানে জেন্ডার সব সময়ই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্মাণ। তাই, নর-নারীর বিষমকামিতা, নারী-নারী/পুরুষ-পুরুষ সমকামিতা, উভকামিতা – কোন যৌনতাই কেবল বায়োলজিক্যাল হতে পারে না। সকল ধরনের যৌনতার বহিঃপ্রকাশ সম্ভব কেবল সুনির্দিষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আবহে বা পরিমণ্ডলে। কোন ধরনের যৌনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, কোনটা সুপ্ত থাকবে তাও আসলে কেবল বায়োলজি ঠিক করবে না। সমাজের অনুশাসন, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রাতিষ্ঠানিক পলিসি, রাষ্ট্রীয় আইন, ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের আলাপে যৌনতার একটা সম্ভাব্য আকার-আকৃতি নির্মাণ চলতে থাকে।এখানে ব্যক্তির বেছে নেয়াটা ঘটে বিদ্যমান চয়েসগুলোর সীমার মধ্যে। ব্যক্তির যৌনতার চয়েস যথেচ্ছ নয়।বিদ্যমান নীতি-নৈতিকতা, পরিবারের গঠন, সম্পদ ও আর্থিক পরিস্থিতি, অভিবাসন, রাজনৈতিক আবহ – সব কিছুই যৌন চয়েসকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এত কথার অবতারণা রূপান্তর নাটকের সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে। ওয়ালটনের স্পন্সর করা জোভান অভিনীত রূপান্তর নাটকটি দেখলাম। লিঙ্গীয় অস্পষ্টতা এবং পরিচয়ের সংকট নিয়ে একটি নাটক যেখানে সমকামিতার প্রসঙ্গ নাই। পুরুষের মত দৈহিক অবয়ববিশিষ্ট একজন তরুণ শিল্পী সৌরভ শেষ পর্যন্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই নারীতে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের ফলে সৌরভ শেষ পর্যন্ত আরেকজন পুরুষকে বিয়ে করবে কিনা, এমন কোন ইঙ্গিত এই নাটকে দেয়া হয় নাই। যদি অনুমান করে নেই, ভবিষ্যতে আরেকজন পুরুষকে সৌরভ বিয়ে করবে, সেক্ষেত্রে সে নারী রূপেই পুরুষকে বিয়ে করছে। যেটা কমনসেন্সে সমকামিতার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা নয়। এই সম্ভাব্য বিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে সংঘটিত নরমাল বিয়ে। তাহলে নাটকটির আলোচ্য বিষয় প্রচলিত মূল্যবোধের সাথে কেন সংঘর্ষ ঘটাবে? প্রকৃতিতে রূপান্তরিত মূল, রূপান্তরিত কাণ্ড যেমন থাকতে পারে, তেমন, রূপান্তরিত মানুষও থাকতে পারে। রূপান্তরিত প্রাণ প্রকৃতির স্বাভাবিক খেলা। প্রকৃতির বিচিত্র রূপকে গ্রহণ করবার নীতি-নৈতিক সমস্যা কোথায়, সেটা আলোচনার সুযোগ থাকতে পারে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, মানুষের এজেন্সি বা তৎপরতা দিয়ে প্রকৃতি সদা-সর্বদা সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। তাই, রূপান্তরিত মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন সব সময়ই মানুষের সমাজের রীতি-রেওয়াজের ফ্রেমওয়ার্কে তৈরি হবে।কেবল বায়োলজি রূপান্তরিত মানুষের জীবনের নির্ধারক নয়। স্পষ্টভাবে যারা নারী নয়, কিম্বা পুরুষ নয়, কিম্বা মধ্যবর্তী কোন অবস্থায় আছে, তাদের বিষয়ে সমাজকে, রাষ্ট্রকে কোন না কোন নীতিমালার ভেতর আসতে হবে, যাতে সকলের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা যায়।
তিন-
এই তো কিছুদিন আগে ব্র্যাকের শিক্ষকের চাকুরী হারানো, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে শরীফ-শরিফা গল্পের মাধ্যমে যৌন পরিচয়ের বৈচিত্র্যকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে পরিবেশন করবার বিষয়ে গণঅসন্তোষ থেকেই যৌন বিভিন্নতার আলাপ এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশের চলমান বিতর্ক যতটুকু হাতে আসে, তা থেকে যেটা বোঝা যাচ্ছে যে, হিজড়া, কিম্বা ট্রান্স মানুষদের নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নিয়ে বেশীর ভাগ মানুষই জেনে-বুঝে মূলধারার সমাজে তাদের জায়গা করে দিতে, নিজেদের মনে স্থান দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু এই আলোচনার ফাঁক গলে নারী-নারী এবং পুরুষ-পুরুষের সমকাম যৌন প্র্যাকটিসকে স্বীকৃতি দিতে সমাজ প্রস্তুত নয়।দেশের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালায়, রাষ্ট্রীয় আইন বা সামাজিক অনুশাসনে সমকামী প্র্যাকটিসকে নরমাল বিবেচনা বরদাস্ত করা হবে না।
কেবল ইসলাম ধর্মে নয়, সমকামিতাকে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আব্রাহামিক ধর্মের নির্দেশনা মেনে চলা বিশ্বাসী গোষ্ঠী তার ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে সমকামিতাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তাই নয় কি? এটা কোন ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয় নয়, এটা তার গোটা কৌমের যৌথ জীবনাচারণ। যৌন নিষেধাজ্ঞাগুলো এক একটি সমাজের বুনিয়াদি প্র্যাকটিস। কখনই ব্যক্তিগত প্র্যাকটিস নয়। যৌন বিধিমালার উপরই এই সমাজগুলো প্রতিষ্ঠিত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলাদেশের বা আমেরিকার বা ব্রিটেনের বা ইউরোপে, অস্ট্রেলিয়ায়- কোথাও মুসলমানরা কঠোর ঐশী নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের ধর্মীয় প্র্যাকটিসের ভেতরে সমকামিতাকে স্থান দিতে পারবে না। কোন আব্রাহামিক ধর্মই নয়। শক্তিশালী এজিবিটিকিউ আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা ইঙ্গ-মার্কিন সমাজ এই বিতর্কে এখন গভীরভাবে বিভাজিত। লেখক : প্রবাসী ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক