সব বর্জনে সব মানুষ সাড়া দেয় না
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
তিন মাস পূর্ণ হয়ে গেছে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের। গত ১৭ জানুয়ারি এই ডাক দিয়েছিলেন প্যারিসে অবস্থানরত বাংলাদেশের একজন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। তার মতে, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সফলতার পেছনে সব রকম সহায়তা করেছে ভারত সরকার। সেই ক্ষোভ থেকে তিনি দেশের মানুষকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। শুরুর দিক থেকে বলা হচ্ছিলো যে, এই বয়কট আন্দোলন প্রযোজ্য হবে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া ভারতীয় যতো পণ্য আছে সেগুলোর ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বাজারে এর ঠিক কী প্রভাব পড়েছে তা হিসাব করে বুঝা না গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ব্যাপক প্রচারণা দেখা গেছে এবং সেটি এখনো অব্যাহত আছে। আমেরিকা, ইউরোপে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিও এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন।
একটি আন্দোলন ৩ মাস সামাজিক মাধ্যমে ধরে রাখা অবশ্যই একটি বড় বিষয় এবং এটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। তবে পণ্য বয়কটের আন্দোলনকে সামগ্রিকভাবে ‘ইন্ডিয়া আউট’ বা ‘ভারত খেদাও’ আন্দোলনে পরিণত করা গেলো কিনা সেটি পরের বিবেচনা। বিষয়টি রাজনৈতিক, কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক জায়গা থেকে দলীয়ভাবে কেউ আন্দোলনে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসেনি। রহুল কবীর রিজভী গত ২০ মার্চ বিএনপির নয়া পল্টন কার্যালয়ের সামনে তার কাশ্মেরী শাল ছুড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের স্লোগান দিলেও তার দল সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেয়নি। বরং বিএনপি থেকে বলা হয়েছে যে, দল ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন চায় এবং রিজভী যা করেছেন সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। বিএনপি দলীয়ভাবে বর্জনে অংশ না নিলেও ফেসবুকে বিএনপির পেজগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে তারা এ আন্দোলনে আছে এবং মানুষকে উদ্ভুদ করার চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয় নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। যারা বয়কটের কথা বলেন তাদের অনেকেই ভারতীয় পণ্য কিনে বলে আমাকে অনেকে বলছেন। যদিও সেটি আমি দেখিনি। কিন্তু এটা সত্য যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য কেনা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। বেড়ানো বা চিকিৎসার প্রয়োজনে লাখ লাখ মানুষ ভারত যায়। এই ভারত বর্জনের প্রচারণার মধ্যেই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে এবং ভারতে রেকর্ড সংখ্যক যাত্রী পারাপার হয়েছে।
মানুষে মানুষে যোগাযোগ এতো নিবিড় যে, বর্জনের ডাক দিয়ে তা বন্ধ করা সম্ভব হয় না। অনেক জায়গায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটি নাগরিক আন্দোলন থাকলেও সেটি প্রকট আকার নেয়নি অনেক স্থানে। তবে অনেকেই সচেতনভাবে ভারতের কাপড় কিনছেন না তা ফেসবুকে এসে জানান দিচ্ছেন। কিন্তু ঈদের সময় সীমান্তবর্তী শহর ও নগরে ঈদ মার্কেট সয়লাভ ছিলো চোরাই পথে আসা ভারতীয় কাপড় দিয়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রচারণার প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে ছোট ছোট দোকানে ভারতীয় শুধু নয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়র বদলে বাংলাদেশি কোম্পানির কোমল পানীয় বেশি বিক্রি হয়েছে।
তবে সামগ্রীকভাবে আমদানিতে কোনো প্রভাব ছিলো না বলেই ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক যে কেউ দিতে পারে। প্রশ্ন হলো সে বর্জন কতোটুকু করা যায়? বাংলাদেশের চিকিৎসা কার্যক্রমের উপর বিরক্ত হয়ে সাধারণ নাগরিকরা যায় ভারতে। কারণ তারা ধনীক শ্রেণি, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড যেতে পারে না। আমরা ভালো করেই জানি যে ভারতের পেঁয়াজ না আসলে বাংলাদেশের বাজারে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। কখনো কখনো চালও আমদানি করতে হয়। সব বর্জনে সব মানুষ সাড়া দেয় না এবং দেবেও না। জীবনের প্রয়োজন তাদের কাছে অনেক বড়।
পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ফেসবুক পেইজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস