হতভাগা সম্প্রদায় বুক চাপড়ায়, তবুও স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে নিয়েই
নাদিম মাহমুদ
বাংলাদেশ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় মন খারাপের কথা বলি। এটা নেই, ওটা নেই, সেটা কেন হয় না, হলো না। বাস্তবতার নিরিখে হয়তো এসব আলোচনা-সমালোচনা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে কিংবা প্রয়োজনও। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া যে একধরনের প্রিভিলেজ সেটা, বিদেশে মাটিতে পা দিলে কিছুটা হলেও বুঝা যায়। বিশ্বাস করেন, আমি যদি আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করতাম আর আমার মা-বাবার আর্থসামাজিক অবস্থান বাংলাদেশের মতোই হতো, তাহলে আমাকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা দিতে হতো না। উচ্চশিক্ষার সুযোগ করতে হয়তো সম্ভব হতো না।
এই তো কিছুদিন আগে আমার সহকর্মীর সাথে কথা হচ্ছিল। সেই নিউইয়ের্কের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে আমাদের ল্যাবে চাকরি করছিল। অনার্স শেষ করতে তার ২ লাখ ডলার (২ কোটি ২০ লাখ টাকা) খরচ লেগেছে, যা ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল আর চাকরি করে মাসে মাসে শোধ করতেছে। শুধু সে একা নয়, এই দেশে প্রায় সিংহভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে ব্যাংক লোন করে। লোনের স্ট্রেস নিয়ে পড়াশোনা করতে হয় তাদের। অথচ আমরা বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছি, ২০০ ডলারও খরচ লাগেনি। সরকারই আমাদের খরচ বহন করে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান নিয়ে হয়তো আক্ষেপ আমাদের আছে, থাকবে তবে মাসিক ১২ টাকা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ পৃথিবীর আর কয়টি দেশে ছিল বা আছে তা সত্যিই আমি জানি না। শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, বাংলাদেশে সবার জন্য যে চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে, সেই ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত আমেরিকা তৈরি করতে পারেনি। বলতে গেলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা যে রয়েছে, মানুষ জরুরি প্রয়োজনে যতটুকু চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে, সেটি এইসব উন্নতদেশে বিরল। আপনি চিকিৎসা নেন বা না নেন, এই দেশে প্রতি মাসে প্রায় কয়েক হাজার ডলার চিকিৎসাবিমায় ব্যয় করতে হচ্ছে, হবে। গত বছরের কথা ধরি না কেন, ছেলে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। একটি আর্জেন্টকেয়ারে নিয়ে গিয়েছিলাম, ডাক্তার থার্মোমিটারে জ্বর মেপে, পালস দেখে ইবোপ্রোফেন নামের সাধারণ একটি মেডিসিন পাসের ফার্মেসি থেকে কেনার জন্য ব্যবস্থাপত্র ধরা দিয়েছিল। পরে বিল এসেছে ১২শ ডলার যা বাংলাদেশে টাকায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অথচ আমাদের দেশে হলে কী হতো?
হ্যাঁ আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে, মান নিয়ে অবশ্যই কথা আছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে চিকিৎসা ও শিক্ষায় বাংলাদেশ তার নাগরিকদের জন্য যে সুবিধা চালু রেখেছে, তা অনেক ধনী দেশে সম্ভব হয় না। গত দশ বছরের প্রবাস জীবনে, অন্তত এইটুকু বুঝেছি শান্তির জায়গা বলতে পৃথিবীর সেরা স্থানটি কিন্তু ‘বাংলাদেশই’। প্রবাসে হয়ত কিছু টাকা পয়সা রোজগার করা যায়, একটা স্বচ্ছল জীবন নির্বাহ করা সম্ভব হয়, কিন্তু মানসিক শান্তি খুঁজতে গেলে আপনাকে ‘বাংলাদেশকেই’ পেতে হবে। কিছু মানুষের জন্য হয়তো দেশটা যে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেই গতিতে যেতে পারছে না, তবে ওইসব জঞ্জালদের সরাতে পারলে, তাদের ডাকাতিকে দমন করতে পারলে বিশ্বাস করেন ‘বাংলাদেশ’ ছেড়ে আর কেউ ভিনদেশে যেতে চাইবে না, যাবে না। আমরা যারা সামান্য সুখের জন্য নিজের মেধা ও শ্রমকে অন্যের ঘরে বিকিয়ে বেড়াচ্ছি, দিন শেষে এই ‘হতভাগা’ সম্প্রদায় বুক চাপড়ায়, স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে নিয়েই। ১৭-৪-২৪। ফেসবুক থেকে