অনাবৃষ্টি ও খরায় বিপাকে রাজশাহীর কৃষকরা
মঈন উদ্দিন, রাজশাহী : বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। চলতি মওসুমে অনাবৃষ্টি ও তীব্র খরায় বিপাকে পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে জমিতে ঘন ঘন সেচ দিতে হচ্ছে তাদের। ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। বর্তমানে তীব্র খরায় খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। বোরো ধানসহ সব ধরনের ফসলের জমিতে কৃত্রিমভাবে সেচ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন কৃষকরা। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ যন্ত্রও বিকল হচ্ছে ঘন ঘন। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের আশঙ্কায় পেয়ে বসেছে সাধারণ চাষিদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে থোকায় থোকায় আম ও লিচুগুটি। কেবল আম ও লিচুই নয়, সব ধরনের মৌসুমি ফল ছাড়াও তীব্র খরায় পুড়ছে মিষ্টি কুমড়া, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, পেঁপে, কাঁচকলার বাগান। এপ্রিলের শুরু থেকেই দেখা নেই বৃষ্টির। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে বোরো আবাদ। তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক জমির উদ্দিন বলেন, টানা অনাবৃষ্টির কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। আগের তুলনায় সেচ যন্ত্র দিয়ে পানি পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম। এজন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হচ্ছে। এতে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। ধান বিক্রি করে এবার উৎপাদন খরচ তোলা কঠিন হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন পাট চাষিরা। মাটি শুকিয়ে যাওয়ায় মৌসুম শুরু হলেও পাট চাষ করতে পারছেন না চাষিরা। বৃষ্টির অপেক্ষা করতে করতে পাট চাষের সময় চলে যাচ্ছে। কৃত্রিম সেচ দিয়ে পাট বপন করলেও স্বস্তিতে নেই চাষিরা। অনেকে সেচ দিয়ে পাট বুনলেও দেখা দিচ্ছে নানা রোগ। পাট গজানোর পরও তপ্ত মাটির কারণে মরে যাচ্ছে পাটের চারা। নওহাটা পৌরসভার পাইকপাড়া এলাকার সবজি চাষি বাহার উদ্দিন বলেন, লেবু, কাঁচাকলা, মরিচসহ তরিতরকারি সবই এখন শুকিয়ে যাচ্ছে। সার-ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। চাষিরা জানান, তীব্র এ খরায় সবজির গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। ফলে সেচ দেয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ঝরে পড়ছে গাছের ফল ও ফুল।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর, বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়। এ বছর এসব উপজেলার আমের বাগানগুলোতে মুকুল এসেছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এরপর আবার গত কয়েক দিনের অতি তাপমাত্রায় আমের বোঁটা শুকিয়ে ঝরে পড়ে যাচ্ছে গুটি। এতে পানির সেচ ও নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেও ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলায় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। জেলায় এবার ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গতবার জেলার ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমি থেকে আমচাষিদের থেকে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৫২৮ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ টাকা। এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ক্ষেতে আর্দ্রতা ধরে রাখতে বিকেলে সেচ এবং স্প্রে দেয়াসহ কৃষকদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে, রাজশাহীতে পানির সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। ক্রমবর্ধমান হারে এই অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষ দৈনন্দিন ব্যবহার্য এবং সেচের পানি পাচ্ছে না।
জেলার তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌরসভার মাহালিপাড়া গ্রামে পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসন ৭০০ ফুট পর্যন্ত বোরিং করেও পানির স্তর পায়নি। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাঘায় অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এখন প্রকট। উপজেলার বাজুবাঘা গ্রামের গৃহবধূ জায়দা বেগম বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে বাড়িতে বসানো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পাশের বাড়ি থেকে পানি আনছি।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ৩টায় রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় রাতেও স্বস্তি মিলছে না। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ধরা হয় তীব্র তাপপ্রবাহ।
গত ১৩ এপ্রিল থেকে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশিই থাকছে। ১৮ এপ্রিল দুপুর ৩টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ১৭ এপ্রিল ৪২.৬ ডিগ্রি, ১৬ এপ্রিল ৪০.৫ ডিগ্রি, ১৫ এপ্রিল ৩৯.৫ ডিগ্রি, ১৪ এপ্রিল ৪০.৬ ডিগ্রি, ১৩ এপ্রিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল।
এর আগে জেলায় মাঝারি দাবদাহ বয়ে যাচ্ছিল। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আব্দুস সালাম জানান, অব্যাহতভাবে দাবদাহ বাড়ছেই। যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, সামনে তাপমাত্রার সঠিক সমীকরণ বোঝা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করছি আগামী কয়েকদিনে মধ্য বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে আসবে।