খরায় পাবনায় লিচু ও আমের গুটি ঝরে পড়ছে
কালাম আজাদ, পাবনা : লিচুর রাজধানী হিসেবে খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রচন্ড খরা ও তীব্র তাপদাহে লিচু ও আমের বোঁটা শুকিয়ে ঝড়ে যাচ্ছে। গাছের গোড়ায় পানি দিয়েও গুটি ঝরা রোধ করা যাচ্ছেনা। ফলে লিচুর ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন চাষিরা। রসালো ও সুস্বাদ লিচু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী, সদর, সুজানগর চাটমোহর, আটঘরিয়াতে বৈশাখের মাঝামাঝিতে গাছে মুকুল আসে এবং চৈত্র মাসে মুকুল থেকে লিচুর সবুজ গুটি দেখা যায়। এখন লিচু গাছের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ছোট ছোট সবুজ গুটি। এ বছর প্রতিটি গাছে রেকর্ড পরিমাণ মুকুল এসেছিল। মুকুল থেকে গুটিও বেশ ভালো হয়। তাই এবার চাষিরা লিচুর ভালো ফলনের আশায় বুক বেধেছিলেন। কিন্তু গত ২৮ মার্চ থেকে অদ্যবধি ২০ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ২৪ দিন প্রচন্ড তাপদাহে লিচুর গুটি ব্যাপভাবে ঝরে পড়ছে। বহু গাছে শুধু বোঁটা দেখা যাচ্ছে। তাই লিচু চাষিদের স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঈশ্বরদী উপজেলার লিচুগ্রাম হিসেবে পরিচিত রাজাপুর, তিনগাছা, ব্যাংগারা, বক্তারপুর, জগন্নাথপুর, বাঁশেরবাদা, জয়নগর, মিরকামারী, মানিকনগর, সাহাপুর, আওতাপাড়া, চরসাহাপুরে লিচুর আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি। সারিসারি লিচুর বাগানের পর বাগান। বিগত বছর গুলোর তুলনায় এবার লিচুর গুটি বেশি ছিল। প্রায় প্রতিটি গাছেই প্রচুর গুটি এসেছিল। কিন্তু প্রচন্ড খরা বৈরি আবহাওয়া অর্থাৎ তীব্র তাপদহে যেভাবে লিচুর বোঁটা শুকিয়ে যাচ্ছে। গুটি ঝরে পড়ছে তাতে ফলনে বিপর্যয় হওয়ার আশংকা রয়েছে।
রাজাপুর গ্রামের রওশন আলী জানান, তার ২০ বিঘা জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। তিনি বলেন, এবার লিচু গাছে রেকর্ড পরিমাণ মুকুল এসেছিল। চৈত্রের খরতাপে লিচুর গুটি খুব ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে গুটি ঝরে পড়া অব্যাহত থাকলে আমাদের (লিচু চাষিদের) ভালো ফলনের স্বপ্নভঙ্গ হবে। তিনি জানান, টানা ২৪ দিন প্রচন্ড খরার কারণে গাছের লিচুর গুটি সব ঝরে যাচ্ছে। রাতে ও সকালে পানি ও ওষুধ স্প্রে করেও গুটি ঝরা রোধ করা যাচ্ছেনা। দিনে প্রচন্ড গরম আবার রাতের আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে। গরম-ঠান্ডার কারণে লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে। এই ভাবে গুটি ঝরে গেলে আশানুরুপের অর্ধেক লিচু ও পাবোনা। বাাশেরবাদা গ্রামেরআদর্শ লিচু চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার আড়াই বিঘা জমিতে লিচুর বাগান আছে। লিচুর গুটি ঝরা রোধে পুরো বাগান লাঙ্গল দিয়ে নালা করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখেও গুটি ঝরা বন্ধ করতে পারছি না। তিনি বলেন, গত বছর শ্যালো মেসিন মালিক ঘন্টাপ্রতি ২ হাজার টাকা নিলেও এবার সেখানে দিতে হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া কীটনাশকের দাম অত্যধিক বেড়েছে। প্রচুর খরচ করেও লিচুতে এবার দুঃখ। তিনি গত বছর তার বাগান থেকে ৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা আয় করেছিলেন। এবার ২ লাখ টাকা আসবে কিনা সংশয় প্রকাশ করেন। ব্যাংগারা গ্রামের লিচু চাষি বিধবা নারী চাম্পা খাতুন আড়াই বিঘা লিচুর বাগানে পানি দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। আর পানি দেয়ার মত অর্থ নেই; তদারকি ছেড়ে দিয়েছি-যা থাকে কপালে।
তিনগাছা গ্রামের বিপ্লব হোসেন ও আসলাম হোসেন জানান, তারা ২২ বিঘা জমিতে লিচুর বাগানে এ পর্যন্ত ৬ বার পানি কিনে দিয়েছেন। এক দিকে পানি দেয়া হচ্ছে; আরেকদিকে সঙ্গে সঙ্গে মাটি পানি চুষে খাচ্ছে। খরার যে অবস্থা; তাতে ফলন তো দূরে থাক-এক চতুর্থাংশ লিচু ও পাওয়া যাবেনা বলে তারা সংশয় প্রকাশ করেন।
কীটনাশক ও সার ব্যবসায়ীরা বলেন, এবার প্রচন্ড খরার কারণে লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে। চাষিরা গুটি ঝরা রোধ করতে আমাদের কাছে এসে পরামর্শ চাইছেন। আমরা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গুটি ঝরা রোধে চাষিদের কীটনাশক দিচ্ছি। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, ঈশ্বরদীতেই এ বছরঈশ্বরদীতে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা রয়েছে ১০ টন। বৈশাখ মাসে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি লিচু গাছে এবার ভালো মুকুল এসেছিল। লিচুর ভালো ফলনের আশাও করেছিল কৃষিবিভাগ। কিন্তু প্রচন্ড খরা ও তীব্রতাপ প্রবাহে লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে প্রচুর। এমতাবস্থায় লিচুর গুটি ঝরা রোধে চাষিদের সঠিকভাবে লিচুবাগান পরিচর্যা করা ও প্রয়োজন মতো কীটনাশক ব্যবহারেরপরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
পাবনা কৃষিসম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দিন জানান, এবছর পাবনা জেলায় লিচুর বাগান রয়েছে ৪ হাজার ৭২১ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭৬৮ টন। আমের বাগান রয়েছে ২ হাজার ৭৩০ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ৯০০ টন। গুটি ধরে রাখতে চাষিদের উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত পরিমাই পানি দেয়ার মাধ্যমে গুটি ঝরা অনেকটা রোধ করা সম্ভব বলে চাষিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক বাগানে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
তবে এবারের প্রচন্ড খরার কারণে লিচু ও আমের গুটি ঝরে পড়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেন এই কৃষিকর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, পাবনায় টানা খরতাপের পর এখানে তাপমাত্রার পারদ তীবৃতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এদিন এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমে পাবনায় এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
পাবনার ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের পর্যোবেক্ষক নাজমুল হক রঞ্জন জানান, বেশ কিছুদিন যাবৎ পাবনা অঞ্চলে প্রচন্ড খরা ও তাপ প্রববাহ চলছে। পাবনায় তীব্র তাপদাহ শুরু হয়েছে। এদিন বিকেল তিনটায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টি না হলে তাপমাত্রা বাড়বেই। আর আপাতত বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই বলে এই কর্মকর্তা জানান।