প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য
আজিজুর রহমান আসাদ
গরম বাড়ছে, স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত হারে। গরম বাড়লে কী হয়? গরম বাড়লে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। সর্দিগর্মি হতে পারে, শরীরে খিচুনি হতে পারে, চরম অবসাদ ও ক্লান্তি হতে পারে, হিট স্ট্রোক হতে পারে এবং হাইপারথার্মিয়া হতে পারে। মানুষ মারা যেতে পারে। আরও বাড়লে কী হবে? পৃথিবী বাঁচবে না। ১৮৫০ সাল থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতার, মানে পৃথিবী গরম হওয়ার একটি হিসাব রাখা শুরু হয়। এই সময়ে, এক দশকে গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ছিল ০.০৬ সেলসিয়াস। ১৯৮২ সালের পরে, এর মাত্রা তিনগুণ বেড়ে হয়েছে ০.২০ সেলসিয়াস। গত দশ বছরে গরম হওয়ার মাত্রা আগের তুলনায় দ্রুত বেড়ে চলেছে, যা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি।
বিজ্ঞানীদের হিসেবে, পৃথিবী এখন ১.৩৬ সেলসিয়াস বেশি গরম, শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার শুরুর সময়ের তুলনায়। মানে শিল্প পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাবৃদ্ধির কারণ। গরম যদি এই হারে বাড়তে থাকে তাহলে এটি এমন এক উচ্চমাত্রায় পৌঁছুবে, যাকে বলে ‘টিপিং পয়েন্ট’। মানে আমরা যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় বাস করছি, এই ব্যবস্থা আর আগের পরিবেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না, যদি এই উষ্ণতা একটি মাত্রা অতিক্রম করে। যেমন, যদি আগামী ৫০ বছরে তাপমাত্রা ১০ সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর প্রকৃতিকে আর বাঁচানো যাবে না। এবং প্রকৃতি যদি না বাঁচে তাহলে মানুষের (আমাদের আগামী প্রজন্ম) জন্য এই পৃথিবী আর বসবাসের যোগ্য থাকবে না। মানে আপনার আজকের ভোগ বিলাস, এসি বাড়ি, এসি শপিং মল, অফিসের গাড়ি আবার নিজের বউ, শালী, শালাদের সবার জন্য এসি গাড়ি, পারফিউম, গরু-শুকর- মুরগি দিয়ে আহার, বিনোদনের জন্য বান্দরবনে বন কেটে রিসোর্ট আর সুইমিং পুল, আপনার ফুটানি দেখানোর জন্য জিন্স আর লেদার জ্যাকেট, মন্দিরে মসজিদে এসি ও মাইকের অব্যাহত বিদ্যুৎ, গণতন্ত্র রপ্তানির জন্য অস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধ, বিলিয়নিয়ার বানানোর জন্য কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ইত্যাদি যা কিছু পুঁজিবাদে উৎপাদিত হচ্ছে, ভোগ এবং অপচয় হচ্ছে, এই সবকিছুর জন্য আপনি আপনার এই সবুজ গ্রহটিকে ধ্বংস করছেন।
আপনার আগামী প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকার উপায় শেষ করে দিচ্ছেন। মানুষের ভোগবিলাসের সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবী ধ্বংসের সম্পর্ক কী? পুঁজিবাদী উৎপাদন অপ্রয়োজনীয় ভোগ-বিলাস ও মুনাফার জন্য, মানুষের বেঁচে থাকার ও উৎসবে আনন্দে মানবিক জীবনচর্চার জন্য নয়। পুঁজিবাদের শিক্ষা, সুখ আসবে ব্যক্তিগত ‘ভোগ বিলাস’ থেকে, সম্পদের ‘মালিক’ হওয়া থেকে। আর ইহকালে গরিব থাকলে পরকালে শুধু ভোগ আর ভোগ। পুঁজিবাদী ‘উন্নয়ন নীতি’ ধনিক শ্রেণিকে আরও ধনী হতে সহায়তা করে, মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়ায়, আর ধর্মান্ধকে আরও ধর্মান্ধ, মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
পুঁজিবাদে উৎপাদিত হয় বিলাসী ভোগ্যপণ্য ও সেবা, ‘বাজারের’ প্রয়োজনে। মানে যারা বাজারে নেই, কিনতে পারে না, তারা না খেয়ে মারা যায়। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে বিত্তবান শ্রেণির ভোগবিলাসের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীকে মেরে ফেলার পথে এগুচ্ছে। পুঁজিবাদে বিত্তবান শ্রেণি যেন পুরুষ মৌমাছি, সংগম লালসায় আত্মহত্যার দিকে উড়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদে ভোগ্যপণ্য ও সেবা উৎপাদনের জন্য যে শক্তি দরকার হয়, তা আসে ‘ফসিল ফুয়েল’ মানে তেল, গ্যাস, ও কয়লা থেকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস’ তৈরি হয়, যার প্রভাবে পৃথিবীতে তাপ আটকে থাকে, বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না। এভাবে ক্রমাগত ভূপৃষ্ঠ গরম হতে থাকে। গরম বেড়ে গেলে, তা শুধু মানুষের স্বাস্থ্য নয়, প্রভাব পরে প্রকৃতির উপর, যেমন খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বন উজাড়, নদী মরে যাওয়া, বরফ গলে যাওয়া।
এর প্রভাব পরে দরিদ্র নারী ও শিশুর উপর প্রকটভাবে। বেড়ে যায় দরিদ্রের মৃত্যুর হার, নারীর প্রতি সহিংসতার সংখ্যা। অন্যদিকে সকল ভোগ্য পণ্য বিক্রয় হয় না, যেমন গাড়ি, বাড়ি, ইত্যাদি, ফলে অপচয় ঘটে। এরপর আছে, ভোগ বিলাসের কারণে নানাভাবে পরিবেশ দূষণ, প্লাস্টিক ব্যবহার, ক্যামিক্যাল ব্যবহার, ইত্যাদি। সহিংসতা চলে প্রকৃতির উপর, মাটি দূষণে, বায়ু দূষণে, জল দূষণে, শব্দ দূষণে, পরিবেশ দূষণে। এক কথায়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতিকে দুষিত করছে, দুনিয়াকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। ফলে, আপনার আশু সমস্যা হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য ‘হিট অফিসার’ নিয়োগ দিয়ে মুল কাঠামোগত কারণ, বা যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, সেই মুল কারণের সমাধান হবে না।
তবে, এখনই আপনাকে আশুসমস্যা ‘হিট স্ট্রোক’ থেকে বাঁচতে হবে। একই সাথে পুঁজিবাদী ভোগবাদী অপরিকল্পিত বাজারের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থা, যা অবৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, এই গোটা ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে, ফসিল ফুয়েলের (তেল, গ্যাস, কয়লা) ক্ষতিকর শক্তির বদলে নবায়নযোগ্য শক্তি আছে। সকল মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সম্পদ তৈরির ‘লাগসই’ প্রযুক্তি আছে (তবে মানুষের লোভ লালসার মাত্রা পুরনের জন্য তেমন কোন প্রযুক্তি নেই)। দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে, মানুষের আনন্দের ও সৃজনশীল ব্যক্তি জীবনচর্চার জ্ঞান আছে। রাজনৈতিক তত্ত্ব আছে সাম্য, শান্তির সমাজ নির্মাণের, পৃথিবীর স্বাস্থ্য রক্ষা করার এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ্য পরিবেশ উপহার দেয়ার।
আজকে মানুষের হাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞান আছে। প্রয়োজন, এই জ্ঞান কাজে লাগানো। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আপনাকে আজই কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথম ও প্রধান কাজ জ্ঞানতাত্ত্বিক। আপনার নিজের ও পরিবারের সকলের, শিশুটিকেও পরিবেশ-প্রতিবেশ সচেতনতা দিতে হবে। আজকের দিনে এটি সহজ, গুগোল করলে আর কমনসেন্স কাজে লাগালে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর আর্থসামাজিক কারণ বোঝা কঠিন কিছু নয়, বাচ্চাদের জানানোও দুঃসাধ্য নয়। দ্বিতীয় কাজ, আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভোগের ক্ষেত্রে, লোভের ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত জিবনাচারের ক্ষেত্রে। কি ভাবে বাঁচবেন? কি বিশ্বাস করবেন? কীভাবে আনন্দে থাকবেন? কী কিনবেন বা কিনবেন না? ভাবুন, কীভাবে আপনার জীবনকে কাজে লাগাবেন মানুষের শ্রমের দায় পরিশোধে এবং প্রকৃতির অবদানের প্রতিদানে। কারণ আপনি বেঁচে আছেন, মানুষের শ্রমে, বৃক্ষের বদান্যতায় ও সূর্যের অবদানে। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য।
লেখক: গবেষক