ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে নির্গত বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব কী
মো. জাহেদুল ইসলাম
আধুনিক বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা এখন আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। ইলেকট্রনিক্স ছাড়া তার জীবন কল্পনা করা যায় না। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ মহাবিশ্বের অনেক শক্তির মধ্যে একটি। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হলো সংশ্লিষ্ট বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক ক্ষেত্র থেকে উৎপন্ন একটি ত্বরিত বৈদ্যুতিক চার্জ। এতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ রয়েছে যা বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে আলোর গতিতে প্রচার করে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ ভ্রমণের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয়না। আধুনিক যুগে আমরা প্রযুক্তির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এতোটাই নির্ভরশীল যে আমরা কিছু প্রযুক্তি ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না। কম্পিউটার, মোবাইল, রাউটার, রেফ্রিজারেটর, বৈদ্যুতিক লাইট ইত্যাদির সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। আমরা সাধারণত সুবিধার কথা চিন্তা করি। কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই এর অসুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগত। আমাদের দৈনন্দিন ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর বেশিরভাগই নন-আয়নাইজিং বিকিরণ নির্গত করে। মোবাইল ফোন তথ্য প্রেরণের জন্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ব্যবহার করে। একটি মোবাইল ফোন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মতো একই পরিমাণ বিকিরণ নির্গত করে। একটি ওয়াইফাই সংকেত অনুসন্ধান করার সময়, তরঙ্গ পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র তৈরি করে যা বিকিরণ তৈরি করে। যে যান্ত্রিক বিন্যাসে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্র একে অপরের সমকোণে থাকে তা বিকিরণ উৎপন্ন করে যাকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বলে। একটি পরমাণুতে ইলেকট্রন সর্বদা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। ফলে নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। অন্য দিকে ইলেকট্রনের প্রবাহ হলো বিদ্যুৎ।
তাই ইলেকট্রনের ঘূর্ণন একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই দুটি ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়া ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের জন্ম দেয়। এ ছাড়া মোবাইল টাওয়ার থেকেও রেডিয়েশন তৈরি হয়। তাই যতোটা সম্ভব মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ইলেকট্রিক ওভেন, ইন্ডাকশন কুকার, ইলেকট্রিক কেটলি ইত্যাদির ব্যবহার যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। রান্না বা খাবার গরম করার জন্য ইলেকট্রনিক রান্নার পাত্রের পরিবর্তে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করা অনেক ধরনের বিকিরণ থেকে রক্ষা করতে পারে। রাউটারগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এমনকি আমাদের বাসা বা অফিসে ব্যবহৃত রাউটার যদি নিম্নমানের উপাদান দিয়ে তৈরি হয় তাহলেও রেডিয়েশনের সম্ভাবনা থাকে। আমাদের চারপাশে একটি রাউটার থাকলে আমরা এটি খুব সহজেই বুঝতে সক্ষম হবো। তারপর আমরা কিছুক্ষণ পরে এটি লক্ষ্য করি। এই বিকিরণ ক্ষতির প্রভাব মূলত রাউটার ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের (তরঙ্গ) শক্তির উপর নির্ভর করে। রাউটার বা ওয়াইফাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের মাধ্যমে ডেটা পাঠায়। যখন আমাদের ওয়াইফাই রাউটার ডেটা প্রেরণ করে, তখন এটি ইএমএফ (ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড) নির্গত করে যা বডি দ্বারা শোষিত হতে পারে। এটি এক ধরনের নন-আয়নাইজিং বিকিরণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের বডি একটি ওয়াইফাই ডিভাইসের কতোটা কাছাকাছি আছে। আমাদের বেশিরভাগ ব্যবহারকারী এখন শক্তিশালী রাউটার ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত খোলা জায়গায় রাউটার ইনস্টল করা। রাউটারটি বন্ধ জায়গায় রাখলে যে পরিমাণ বিকিরণ নির্গত হয় তা আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে সহজ ও দ্রুত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দিয়েছে। খুব সহজে খাবার রান্না করতে ইন্ডাকশন কুকার, রান্না করা খাবার ভালো রাখতে ফ্রিজের ব্যবহার, ফ্রিজে ঠান্ডা খাবার গরম করতে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যবহার।
সবকিছু একই সময়ে আন্তঃসম্পর্কিত। এদিকে স্মার্টফোন, টিভি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ওয়াইফাই এখন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এই দৈনন্দিন সঙ্গী ডিভাইসগুলো দ্বারা নির্গত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বডজের মারাত্মক ক্ষতি করছে। আমরা সাধারণত মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করার জন্য যে তরঙ্গগুলো ব্যবহার করি সেই তরঙ্গগুলো একটি বেতার রাউটারে বিকিরণ করা হয়। ওয়াইফাই সিগন্যাল ত্বকের মধ্য দিয়ে যায় ও বোডজে প্রবেশ করে। ল্যাপটপের নিচের অংশটি তীব্র ইএমএফ তৈরি করে যা বডিজের সংস্পর্শে এলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আমাদের কোলে বা পায়ে ল্যাপটপ ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ল্যাপটপ রেডিয়েশন শিল্ড ব্যবহার করা উচিত। যাতে উপরের বোডজে ক্ষতিকারক প্রভাব না পড়ে। পুরানো বৈদ্যুতিক বোর্ড, পুরানো বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত প্রধান সুইচ ইত্যাদি ক্রমাগত বিকিরণ নির্গত করে। এছাড়াও রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদির সঙ্গে ব্যবহৃত ভোল্টেজ স্টেবিলাইজার/ইনভার্টার ডিভাইসগুলো তিন থেকে পাঁচ ফুট চারপাশে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড নির্গত করে। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল টেলিভিশন তারে ব্যবহৃত হয়। যা পরবর্তীতে ইলেকট্রন বিমে রূপান্তরিত হয়। যদি মোবাইল ফোনটি টিভি সেটের কাছাকাছি থাকে তবে ফোন কলটি আসলে মোবাইল ফোনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনকে টেলিভিশনের ইলেকট্রন বিমের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। ফলে টেলিভিশনের ইলেকট্রনিক সিগন্যাল পরিবর্তিত হয় ও বিকিরণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ব্যাপক। অতিরিক্ত স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে যে পরিমাণ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন তৈরি হয় তার ফলে বোডজে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ দেখা দেয়। তাই ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাউটার, মডেম ও অন্যান্য ইন্টারনেট ডিভাইস বন্ধ করে রাখা ভালো। এ ছাড়া স্মার্টফোন, মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস মাথার পাশে রেখে না ঘুমানোও ভালো। স্মার্টফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় হেডফোন বা স্পিকার ব্যবহার করা উচিত। প্রয়োজনের পর স্মার্টফোনের বিভিন্ন সেবা যেমন ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, জিপিএস, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি বন্ধ করা খুবই জরুরি।
লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান, আইসিটি সেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার