সৌদি আরবের আবহাওয়া ঢাকার চেয়েও সহনীয় এবং স্বস্তিদায়ক
শরিফুল হাসান
মরুভূমির দেশ বলে পরিচিত সৌদি আরব থেকে সবুজ শ্যামল এই বাংলাদেশের রাজধানী শহর আমার ঢাকায় নামলাম। কিন্তু ঢাকায় নামার পর থেকে গত ছয় ঘণ্টা যে ভীষণ গরম লাগছে তাতে মনে হচ্ছে লু হাওয়া বইছে। ভীষণ গরমে সিদ্ধ হয়ে হচ্ছি। অথচ এই যে টানা আটদিন সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে ছিলাম সেখানকার আবহাওয়া ঢাকার চেয়ে সহনীয়, ঢাকার চেয়ে স্বস্তিদায়ক। সেখানে আমার চলতে ফিরতে গরমে সেভাবে কোনো কষ্ট হয়নি যেভাবে আমার নিজের দেশ নিজের শহর ঢাকায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অথচ উল্টো হবার কথা ছিল। বহুদিন ধরে বলছি, ঢাকাকে আমরা সবাই মিলে তিল তিল করে হত্যা করছি। দেখেন এই শহরের চারপাশে নদী ছিল। শহরের মধ্যে ছিল খাল। অসংখ্য পার্ক আর গাছপালা ছিল। উন্নয়নের নামে সব আমরা শেষ করছি। কারণ আমাদের কাছে উন্নয়ন মানে বড় বড় অবকাঠামো, বড় বড় ভবন, ফ্লাইওভার। সেখানে সবুজ থাকবে না প্রাণ প্রকৃতি থাকবে না?। কেবল ঢাকা নয় প্রতিটি শহরকে এভাবে শেষ করা হয়েছে।
দেখেন যাদের আমরা মরুভূমি বলি সেই সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকাসহ গোটা পৃথিবীর অন্তত ৬০-৭০ টা শহর দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের উজাড় করে সব দিয়েছিলেন। আসলেই আমাদের দেশ সোনার বাংলাদেশ। দেখেন যে দেশে হাজার হাজার নদী, বিশাল বঙ্গোপসাগর, যে দেশে বীজ ফেললেই গাছ ওঠে সেই দেশ সোনার দেশ নয় তো কী? আফসোস সেই সোনার দেশকে আমরা রোজ অব্যবস্থাপনা দিয়ে হত্যা করছি। আপনারা যারা সৌদি দুবাই দোহা ঘুরেছেন দেখবেন, মরুভূমির এই দেশগুলোতে একটা গাছ লাগানোর জন্য কতো চেষ্টা করে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওরা গাছের যত্ন করছে। বাংলাদেশ থেকে ওরা নিম গাছ লাগিয়েছে। মোড়ে মোড়ে পার্ক করছে। অথচ প্রকৃত আমরা থেকে পাওয়া সব গাছ কেটে নদী নালা খাল বিল পার্ক সব শেষ করছি।
২৩ বছর আগে আমি ঢাকা শহরে এসেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কিন্তু এতো গরম লাগতো না। কারণ আমার জহুরুল হক হলে পুকুর ছিল, গাছ ছিল। গত দুই দশকের আমার সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতো শতও গাছ কেটে সবুজ হত্যা করে উন্নয়নের নামে ইটের পার্ক বানাতে দেখলাম। জীবন জীবিকার কারণে হল ছাড়ার পর গত ১৬ বছরে মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, গুলশানে থেকেছি। পুকুরগুলো দখল করে সব ভবন হচ্ছে। পার্কগুলো শেষ হচ্ছে। রাস্তার সব গাছ কাটা হচ্ছে। বাসার সামনের রাস্তার একটা গাছ বাঁচাতে আমাকে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকেও অনুরোধ করতে হয়েছে। আসলে আমরা আমাদের সব সবুজ হত্যা করতে চাইছি। আরেকটা উদাহরণ দেই। বছর ছয় আগেও গুলশানের কাছে নিকেতন পার্কে শত শত গাছ ছিল। সবুজ ছিল। অসংখ্য পাখ-পাখালি ছিল। এরপর উন্নয়নের নামে ১৫-২০ কোটি টাকা খরচ করে সেখানকার অধিকাংশ গাছ কাটা হলো। এরপর চারপাশে গ্লাস লাগানো হয়েছে। ভীষণ গরম লাগে এখন সেখানে। অথচ এর চেয়ে অনেক কম টাকায় সেখানে আরো কয়েক লাখ গাছ লাগানো যেত।
আসলে আমরা উন্নয়নটাই বুঝি না। ফল কখনো চট্রগ্রামের সিআরবির শতবর্ষী গাছ, কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার অদ্ভুত সব পরিকল্পনা আমরা করি। শহরের সব নদী খাল দখল করাটাকে আমাদের উন্নয়ন মনে হয়। বড় বড় ভবন মানেই আমাদের উন্নয়ন। ফলে দেখেন যানজট, দূষণ, দুর্ভোগসহ সব অব্যবস্থাপনায় আমরা পৃথিবীর শীর্ষে। এই ঢাকা শহরে থেকে সাংবাদিকতা করে, নানা কাজ করতে গিয়ে গত যুগে ধরে আমার উপলব্ধি, বাংলাদেশের অভাবটা অর্থের নয়, অব্যবস্থাপনার। আমরা আসলে সভ্যতা ভব্যতা খুব একটা শিখিনি। সুশাসনের ঘাটতি এখানে প্রচণ্ড। আমরা আসলে জানি না আমরা এই দেশটাকে এই ঢাককা শহরটা কে কেমন বানাতে চাই। যাই হোক এতো কথা বলছি, কারণ আমি বিশ্বাস করি এই পুরো ঢাকা শহরের কোটি কোটি গাছ লাগানো, পুরো শহরটা সবুজ বানিয়ে ফেলা খুব কষ্টের কাজ না। একটা শহরের গণপরিবহন, অবকাঠামো, পানি, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সব কিছুর জন্য দরকার সত্যিকারের পরিকল্পনা। দেখেন একটা শহরের সব নদী নালা খাল পুকুর শেষ করে কোটি কোটি টাকা দিয়ে বড় বড় ভবন বানানো কোন স্বার্থকতা নয় বরং সুন্দর সবুজে করে রাখাটাই স্বার্থকতা। পৃথিবীর সব সভ্য শহরে দেখবেন একটু পর পর পার্ক থাকে মাঠ থাকে সবুজ থাকে। কারণ এগুলো একটা শহরের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।
একটা দেশে চারমেয়াদ ধরে একটা সরকার ক্ষমতায়। তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরি। এই শহর নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কী? কেন এই শহর দূষণে প্রথম থাকবে? কেন এই শহরের নাগরিকদের একটা দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী নগর কর্তৃপক্ষ কী করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জরুরি। এই দেশের নীতি নির্ধারকসহ সবার কাছে আকুতি চলুন আমরা আমাদের এই বাংলাদেশটা বাচাই। সবুজ শ্যামল একটা দেশকে আমরা মরুভূমি বানিয়ে ফেলবো এরপর গরমে হাঁসফাঁস করবো এভাবে চলতে পারে না। আমি মনে করি এই পুরো ঢাকা শহরকে এই শহরের সব শহরকে আগামী পাঁচ দশ বছরের মধ্যে গাছ গাছালি আর পাখ পাখালি দিয়ে ভরিয়ে তোলা কঠিন কাজ নয়। শুধু হাজার কোটি টাকা খরচ করে অবকাঠামো বানালেই উন্নয়ন হয় না দরকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য! দরকার সবাইকে নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। সে কারণেই এই লেখা। এই অনুরোধ। চলুন পুরোপুরি ধ্বংস হবার আগে এই ঢাকা শহরটাকে এই দেশটাক বাঁচাই। যা তা না করে একটু দীর্ঘ পরিকল্পনা করি। সবগুলো শহরের জন্য এই কথা প্রযোজ্য। আশা করি কঠিন ভবিষ্যতকে সামনে রেখে আমরা প্রস্তুতি নেব। আশা করছি ধ্বংস হবার আগেই আমাদের সবার বোধ ফিরবে। ভালো থাকুষ সবাই। ভালো থাকুক এই বাংলাদেশ।
লেখক: কলামিস্ট
সূত্র : ডেইলি স্টার