নারীর সংসারের মালিকানা
সায়েমা খাতুন
নারীদের সমান সম্পত্তি লাভের আলাপে কেবল যে পিতার সম্পত্তিতে ভাইয়ের সমান অধিকার বুঝানো হয়, বিষয়টা কি গোলমেলে লাগে না? পিতার বাড়িতে থাকা অবস্থায় নারীরা মোটাদাগে সম্পদ সৃষ্টিতে সাধারণত তেমন কোন কাজ করে না। বাবা-মায়ের সাথে থাকবার সময় বরং, তারা তাদের ২৪ ঘণ্টা ৭ দিনে সম্পদ, খাটাখাটুনী, এনার্জি, মনোযোগ মেয়েদের জন্যে খরচ করেন। অনেক বাড়িতে মেয়েদের দিয়ে মা সংসারের কাজ করান না, এই বলে যে, তাকে নিজের সংসারে অনেক খাটনির দিন সামনে পড়ে আছে, মা যদিও কিছু সাহায্য প্রত্যাশা করেন, বাবারা মেয়েদের নিজের কাজে না লাগিয়ে বরং আরও সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেন। ভবিষ্যতের কষ্টের কথা চিন্তা করে তাদের অনেকটা বিশ্রামে রাখা হয়। এই অতি সম্প্রতি হয়তো চাকরী করা মেয়েরা তার বেতনের কিছু টাকা মা-বাবার জন্যে ব্যয় করবার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু, সেটাও ঠিক সামাজিক নরমেটিভ প্রত্যাশা নয়, এটাকে সমাজে এখনও মোটামুটি নেতিবাচক হিসাবে দেখানো হয়। মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেও আজকাল ভাল থাকা পয়সা খরচ করা হচ্ছে। আমার নিজের দেখা অনেক পরিবার মেয়েদের সমান সম্পত্তি দিতে ছেলের আগেই লিখে দিচ্ছেন। ছেলে পাবে মৃত্যুর পরে। এই বাবামায়ের রোগে-শোকে, বৃদ্ধ অবস্থায় তাদের সময় দেয়া, দেখাশোনা, প্রয়োজনে টাকা পয়সা যোগানোর দায়িত্বও মেয়েরা ঠিক পুরোপুরি নিতে পারে না। কেননা, তার সময় কেড়ে নেয় আরেক গৃহস্থালি।
প্র্যাকটিকালি, প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের পূর্ণ শক্তি যেখানে ব্যয় হয়, পরিশ্রমের মূল সময়টা যেখানে নরমেটিভ ভাবে কাটে সেটা হল, নতুন যে সংসারে সে প্রবেশ করে, সেটাই তার মূল কর্মক্ষেত্র। সেখানে তার ২৪ ঘণ্টা সাত দিনের খাটুনী, সময়, এনার্জি, দক্ষতা দিয়ে একটি গৃহস্থালি গঠন করতে হয়, যেটা অনেকটা জাহাজের ঘাঁটির মত, যেখান থেকে নৌকাগুলো ছেড়ে যায় বিভিন্ন ব্যবসা করে নতুন সম্পদ নিয়ে ফেরার জন্যে। এই গৃহস্থালিগুলো সমাজ ও অর্থনীতির ফাউণ্ডেশন রচনা করে।অথচ, এই অর্জিত সম্পদে নারীর হক নিয়ে কেউ কোন আলাপ তোলে না।
পৃথিবীর কোন ইকোনমি গৃহস্থালির পাটাতন ছাড়া চলতে পারে না। পুঁজিবাদী ইকনমি এই গৃহস্থালির গুরুত্বকে অদৃশ্য করে রাখে। ফলে মেয়েদের কাজের মূল জায়গাটাও অদৃশ্য হয়ে যায়। পুঁজির মালিক পুরুষের কাজগুলোকে তাও বেতন দিয়ে মূল্য দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মেয়েদের নরমেটিভ কাজকে তারা ফ্রি ভোগ করে। আবার মেয়েদের শ্রম, বুদ্ধি, সৌন্দর্য, যৌনতা, মাতৃত্ব – সবকিছুকে সের দরে বেচে দেয়ার হাজারো ফন্দী বের করেছে। কয়েকশত বছর আগেও কৃষক সমাজে ঘর-গৃহস্থালি জীবনের কেন্দ্র ছিল বলে মেয়েদের কাজও ছিল সমাজের কাছে মূল্যবান। এখন যে আধুনিক নগরসমাজ, সেখানে, যাকে এখন বলেন হাউজহোল্ড, এই অতীব প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানটাকে অদৃশ্য এবং গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে, নারী ও শিশুরা এর মর্মান্তিক ভুক্তভোগী।পুরুষেরাও ভুক্তভোগী। কিন্তু নারী ও শিশুদের প্রয়োজনগুলো একেবারে গায়েব করে দেয়া হয়েছে। এক সময়ের শারীরিক, সামাজিক, মানসিক, আবেগিক, আধ্যাত্মিক বিশ্রাম ও আশ্রয় দেয়ার কাঠামো হয়ে দুর্গঘাঁটির মত ঘরগুলো আর থাকতে পারল না। এখন নারী তথাকথিত স্বাধীনতার জন্যে সম্পূর্ণ শ্রমবাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চাকরী কিভাবে স্বাধীনতা হয়, এটা কখনও ভেবে দেখছেন? চাকরী কি এক ধরনের অধীনতা নয়?স্বাধীন চিন্তা ও বিবেক সম্পন্ন কোন লিবারেটেড মানুষ কি বেতনের জন্যে মরাল-এথিকাল বিবেচনাহীন মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের অধীনে চাকরী করার কথা? অথচ কি আশ্চর্য মধ্যবিত্ত্বেরা চাকরীকে স্বাধীনতা বলে ভাবে ও প্রচার করে। ফলে নারীর স্বাধীনতা মানে দাঁড়াচ্ছে, বেশীর ভাগ সময়ে নিজের খাইখোরাকি নিজের পরিশ্রমে নিজেকে যোগাড় করে নেয়া, যেটা আদৌ তার টু ডু লিস্টে ছিল না, অথচ, যেখানে ট্র্যাডিশনাল কেয়ার ওয়ার্ক এবং ভূমিকাগুলোর বোঝা এতটুকু নড়চড় হয় নাই। স্বাধীনতা তো দূর কি বাত, ওয়ার্ক- লাইফ ব্যালেন্স করতে গিয়ে মেয়েরা এখন জেরবার। মেয়েদের যেখানে জীবনের মূল পরিশ্রম ঢালতে হয়, সেখানে যে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে নারীর হক, মালিকানা, অধিকার নিয়ে এ যাবৎকালে কোন আলাপ আমার চোখে পড়ে নাই। লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।