আনু মুহাম্মদ আমাদের গার্ডিয়ান এঞ্জেল
সায়েমা খাতুন
আমার আব্বার অধুনা লুপ্ত দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রায় চাকরীর সুবাদে কিশোরবেলা থেকেই আমি আনু মুহাম্মদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। সেই সময়ে পুস্তকের কীট হিসাবে আমি তাঁর প্রতিবেদনগুলো পড়ে পড়ে জমিয়ে রাখতাম।দেশের অর্থনীতির কঠিন বিষয়গুলো হাইস্কুলের একজন নাম না জানা কৌতূহলী নবীন কিশোরীকে তিনি সার্থকভাবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বিচিত্রার পুরনো সংখ্যাগুলো হয়তো এত বছরে তেলাপোকার খাবার হয়ে গেছে, বা আম্মা বাড়িতে জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে সের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জাহাঙ্গীরনগরে এসে যা কিছু আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিল আনু মুহাম্মদের মত প্রথাবিরোধী কিছু শিক্ষকের কাছ থেকে বিশ্বকে জানতে পারা, বুঝতে পারা, দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে দেখতে পাওয়ার সুযোগ, নিজের জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস খুঁজে পাওয়া। আমার জীবনকে সার্থক মনে হয় যে, আমি শেষ পর্যন্ত এঁদের সহকর্মী হয়ে দীর্ঘ জীবন যাপন করতে পেরেছি এবং যা কিছু এঁরা আমাকে দেখতে শিখিয়েছেন, তার সবকিছুর জন্যে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ!
এই সময়কালটা ছিল গোটা নব্বইয়ের দশক।পরবর্তীকালে শূন্য দশকে আমি নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবেও সেই অভিজ্ঞানকে ধারণ করে গেছিলাম। দেশের ভেতর যেমন বড় বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছি, তেমনি আমার নিজের জীবনেরও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল।আমার চিন্তার জগত, আমার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, জীবনের গতিপথ সবকিছু বদলে গিয়েছিল এই সান্নিধ্য, সাহচর্য ও প্রভাবে।ব্যক্তিগত কেরিয়ার গড়ে তোলার ধ্যান-জ্ঞান উৎরে একটা বৃহত্তর জীবনের আহ্বানে যেন বিগত ও অনাগত সব দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনা-কষ্ট ভোগের ভেতরও একটা অনির্বচনীয় সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলাম।তখন মনে মনে ভাবতাম, দেশের কাজে প্রয়োজনে যে কোন দুঃখকে বরণ করে নেব। মনে হয়েছিলো, এটাই সেই যাপনের যোগ্য জীবন। কেবল আমি সফল মানুষ হবো, আমি জিতব, আমি উপরে উঠবো- সাকসেসফুল মানুষ হওয়ার যে চাপ আমাদের নাগরিক মধ্যবিত্ত্ব পরিবারগুলোতে ছিল, তার বাইরে এক ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ অথচ রোমাঞ্চকর জীবনকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হতে পেরে ছিলাম। এই অংশটুকু হয়তো আমি আজও ঠিকভাবে লিখতে প্রস্তুত নই। কিন্তু এই সময়ে চিন্তার বাঁকগুলো কিছু বিশেষ জায়গায় আনু মুহাম্মদের ভাবনার শক্তিতে কিভাবে চিরস্থায়ীভাবে বদলে গিয়েছিল সেইটুকু না লিখে পারছি না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগে পড়তে হলে অন্য বিভাগের কোর্স পড়তে হত, সেই সুবাদে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ নৃবিজ্ঞান বিভাগে কিছু কোর্স পড়াতেন এবং আমাদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। ধর্ম ও নৃবিজ্ঞান এবং সম্প্রতিক ইস্যু নামক দুইটা কোর্স তার কাছে পড়েছিলাম।বিশ্বাস করবেন, সেইসব আলাপ আজও ভুলি নাই? এই সময়ে আমরা ৮ মার্চ পর্ষদ বলে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলাম, যেখানে আমরা ক্যাম্পাস এবং দেশের লিঙ্গীয় রাজনীতি নিতে কথা বলা শুরু করি।অনেক ছোট-বড় ক্রিটিক, আলোচনা চলছিল।সেখানে আমাদের সংগ্রামের একটা যৌথ জীবনের আকার-আকৃতি গড়ে উঠেছিল।ঢাকা শহরের নানা জায়গা থেকে, দেশের নানা অঞ্চলের মানুষ, বিভিন্ন তরুণ সংগঠকদের সাথে পরিচয় হচ্ছিল যারা একটি কাছাকাছি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে চাচ্ছিল।আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশে সামিল হয়েছিলাম।লেখালেখি করছিলাম। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে সম্মিলিত হয়ে পাহাড়িদের উপর জুলুম-নির্যাতনের বিষয়টিকে নিয়ে কথা বলছিলাম।
এই সময়ে তার লেখা নারী, পুরুষ, সমাজ – বইটি প্রকাশিত হয়।সেই সময়ের জন্যে এটি ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে লিঙ্গীয় রাজনীতি নিয়ে সহজ ভাষায় লেখা একটি হ্যাণ্ডি রেফারেন্স। এর পর আমরা রেহনুমা আহমেদের কাছ থেকে লিঙ্গীয় রাজনীতি নিয়ে আরও গভীর ও সূক্ষ্ম রাজনীতির বিষয়গুলোকে নিয়ে বিস্তৃতভাবে জানা-বোঝা শুরু করেছি। সেই আলোচনাগুলো লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে তখনকার জানাশোনার তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিল। আটানব্বইয়ের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সময় আমাদের এই সব তাত্ত্বিক জানাবোঝা সত্যিকারের পরীক্ষার মুখে পড়ে।এই জানাবোঝা মাঠের আন্দোলনে ধীরে ধীরে আরও পরিপক্ব হতে থাকে। ক্রমাগত আমাদের আরও বড় বড় পরীক্ষার সামনে পড়তে হয়।আমরা বৃহত্তর ঐক্য গঠনে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চ তৈরি করে টিএসসিতে কনভেনশনও করেছিলাম। এই সময় মাল্টি-ট্যালেন্টেড অধ্যাপক মানস চৌধুরী কার্টুন আঁকতে শুরু করেন এবং আমাদের জন্যে একটি পথ-নাটক লেখেন, যেখানে ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের সাথে প্রশাসনের সংঘাতগুলোকে নিয়ে রঙ্গরস সৃষ্টি করা হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে আমরা সংহতি জানাতে যোগ দেই। এই সময়ই আমরা প্রথম জ্বলি না উধিম কিত্তেই নামে একটি সংকলনে প্রথম তেল-গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলোর ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। সেই সময়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ছাড়া আর কেউ, কোন একজনও বিশেষজ্ঞ, কোন অর্থনীতিবিদকে এই নিয়ে আওয়াজ করতে দেখি নাই। “জ্বলি না উধিম কিত্তেই” প্রকাশনাটির পাশাপাশি আমরা আরও প্রকাশনা ও লেখালেখি থেকে দেশের পাহাড়ি ও সমতলী বহুজাতিক গোষ্ঠীগুলোর কোণঠাসা অবস্থা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি।নব্বইয়ের দশকের শেষে, শূন্য দশকের শুরুতে লিঙ্গ রাজনীতি, তেল-গ্যাস ক্ষেত্র ইজারার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, বহুজাতিসত্ত্বার দমন-পীড়ন – এই তিনটি বৃহৎ বেইনসাফের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে সেই সময়ের হাজার হাজার তরুণেরা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেছিল, যাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। বিএনপি, আওয়ামী – সব আমলেই কিভাবে এই রাজনীতি বহাল থাকে এবং প্রবল শ্রেণি, অলিগার্ক শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ন জারী রাখে, তার খুঁটিনাটি আমরা আনু মুহাম্মদের শিক্ষা থেকে বুঝতে শুরু করেছিলাম।বিশ্বব্যাবস্থা তত্ত্ব জেনে-বুঝে আমাদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল।কেন্দ্র ও প্রান্ত তৈরি করে একটি গ্লোবাল অলিগার্ক গোষ্ঠী কিভাবে বিশ্বের স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর সমাজকে নিরন্তরভাবে পরোক্ষভাবে নতজানু করে রাখে- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের কারসাজিতে কিভাবে আমাদের চিরকাল ঋণগ্রস্থ করে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা আমাদের চোখের সামনে খোলাসা হতে থাকলো। একটা কথা এখনও মনে পড়ে যে, কিভাবে জ্বালানী মন্ত্রী-আমলারা দেশের গুরুতর স্বার্থ সামান্য অংকের বিনিময়ে বিক্রি করে দিচ্ছে, মাত্র কোটি টাকা দামের সামান্য একটা গাড়ি, বা বিদেশে ছেলেমেয়ের পড়বার খরচ নিয়ে দেশ-বিরোধী চুক্তি সই করে ফেলছে। খনিজ ব্যবস্থাপনার দেশীয় সংস্থা বাপেক্সকে অকার্যকর করে রাখে, তেল-গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও ব্যবস্থাপনা করতে দেয় না, সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। যে বিষয়গুলো দশকের পড় দশক ধরে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু খনিজ সমৃদ্ধ দেশেও ঘটেছিল। এই কিছুদিনের মধ্যেই সিলেটের মাগুরছড়ায় বিপুল গ্যাস পুড়ে পরিবেশের অচিন্তনীয় ক্ষতির দায়দায়িত্ব নেয়া এবং ক্ষতিপূরনের দাবীতে আমরা বহুজাতিক কোম্পানি নাইকোর বিরুদ্ধে লং মার্চে যোগ দিয়েছিলাম এবং সভাসমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলাম।এর পর ধীরে ধীরে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-খনিজ তথা জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন বেগবান হতে থাকলো। ফুলবাড়ির কয়লাক্ষেত্রের উন্মুক্ত খনন আর সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনসহ এক জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হল। এই সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সম্পূর্ণ সফল হতে না পারলেও, দেশের শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচার লুটপাটের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সর্বজনকে অবহিত করেছে, চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যৌথ চৈতন্য তৈরি করেছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।অন্তত আমাদের চোখ খুলে গেছে, প্রচণ্ড বিভীষিকা ও বিস্ময়ে আবিষ্কার করতে পারলাম, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানী – কোন বিদেশী শক্তি না, এখন খাঁটি দেশজ গণদুষমন অলিগার্করাই দেশের হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ অতি দ্রুতগতিতে বিদেশের পাচার করে দিচ্ছে।
যদিও আজ বাংলাদেশের লুণ্ঠিত গণতন্ত্র কবে কিভাবে ফিরে আসবে, আমরা জানিনা, কিন্তু চোখ খুলে দেখুন, এই দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম, সর্বজনের শাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে বিচিত্র কৌশলে, সর্বফ্রন্টে। আজ গণতন্ত্রবিহীন দেশে অরাজক এক সময়ের প্রদোষ অন্ধকারে একটি নতুন যুগের প্রাক্বালে, রণজিৎ গুহের এই আলাপ আমি বার বার স্মরণ করি যে, সিপাহি বিদ্রোহের আগেও গোটা ভারত জুড়ে অন্তত আড়াই শ’ ছোট-বড়-মাঝারি স্থানিক বিদ্রোহের খবর পাওয়া যায়, যা ছোট-বড় মাত্রার ভূমিকম্পের মত ইংরেজ শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল, তাই, ব্রিটিশ শাসননীতি কেবল ব্রিটিশরাই বানায় নাই, সেটা গড়ে উঠেছিল এই বিদ্রোহগুলোর প্রতিক্রিয়ার। সেকারণে এই শাসননীতির রচয়িতা কেবল কলোনিয়ালরা নয়, ভারতের কৃষক-জনতাও বটে।একই ভাবে আজও সর্বজনের নিরন্তর প্রতিরোধ অলিগার্কের শাসনের নীতিকে সব সময়ই পাল্টে দিচ্ছে, যেমনটি আনু মুহাম্মদ বলেছেন, কোন আন্দোলনই বৃথা যায় না। লেখক: সাবেক জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।