আমাদের শিক্ষা, গবেষণা আর অবকাঠামো উন্নয়ন বিপরীতমুখী হওয়ায় কখনো টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না
ড. কামরুল হাসান মামুন
আমি জীবনের প্রথম চীনে যাই ১৯৯৫ সালে লন্ডন থেকে স্টাটিস্টিক্যাল ফিজিক্সের মেগা কনফারেন্স খ্যাত স্টেটফিজ-১৯ এ যোগ দিতে। এই কনফারেন্সটি হয়েছিল চীনের ঢরধসবহ শহরে। তখন আমি আমার পিএইচডির থিসিস লিখছিলাম। তারপর বেইজিং গিয়েছিলাম ২০০৫ সালে এরপর ঐধহমুযধঁ যাই ২০১৮ সালে। প্রত্যেকটি ভিজিটই ছিল কোনো না কোনো কনফারেন্সে যোগ দিতে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ হয়ে ২০১৮ সালে এই তিন সময়ে ৩ বার যাওয়ার মাধ্যমে আমি চীনকে বদলে যেতে দেখেছি। শুধু বদলে যাওয়া না। বলা যায়, বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং তা এমন পরিবর্তন, যা সম্ভবত পৃথিবীর মানুষ আর কোথাও কখনো দেখেনি। এইটা কি এমনি এমনি হয়ে গেছে? চীনের মতো দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নও উল্লেখযোগ্য তবে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নের পেছনে আমেরিকা তথা ইউরোপের অবদান বিশাল। কিন্তু চীনের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পেছনে অন্য কোনো দেশের কোনো হাত নেই। হাত নেই বললে ভুল হবে। হাত আছে, কিন্তু সেটা ছিল চীনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার জন্য। আমেরিকার নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব নানা অজুহাতে নানা সময়ে কাজ করেছে চীনের অভূতপূর্ব সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে। কিন্তু চীন তার অভীষ্ট লক্ষ থেকে এক চুল পরিমানও নড়েনি।
চীনের উন্নয়ন হয়েছে একটি গবেষণালব্ধ, ফরংপরঢ়ষরহবফ চিন্তা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে। বিশাল জনগুস্টির এত বিশাল একটি দেশকে বোস-আইনস্টাইন কন্ডেন্সেশনের মত কোহেরেন্টলি পরিচালনা না করলে এই অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব না। এখানে কোথাও সামান্য একটু ধহধৎপযু হলে তার নঁঃঃবৎভষু বভভবপঃ এর মত ডিভাস্টেটিং ফলাফল হতে পারে। আজকের চীনের উন্নয়নের বীজ বপন হয় সেই ৫০-৬০ দশকের দিকে যখন চীন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একদল বিজ্ঞানী নির্বাচন করে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়াতে পাঠিয়েছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য। উদ্দেশ্য তারা ফিরে এসে একেকজন শত মানুষ তৈরী করবে। সেই নির্বাচিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে আমার ওঈঞচ-তে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক অধ্যাপক ণঁ খঁ ছিলেন একজন। ওঈঞচ থেকে অবসরে গিয়ে তিনি চীনে ফিরে গিয়ে চাইনিজ একাডেমী অফ সাইন্সের প্রেসিডেন্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই শিক্ষায় চীনের বিপ্লব শুরু হয়। তার পরামর্শে চীন সরকার বিজ্ঞানীদের প্রতিটি আর্টিকেল উন্নত জার্নালে প্রকাশিত হলে নগদ অর্থ দিয়ে উৎসাহিত করা শুরু হয়। আজকে গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশনায় চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এখনো ইনোভেশনে এখনো ছাড়াতে পারেনি। অধ্যাপক ণঁ খঁ ও চাইনিজ একাডেমী অফ সাইন্সের পরামর্শে চীন সরকার সহস্র ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম শুরু করে। এর মাধ্যমে চীনের অন্তত দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঞংরহমযঁধ ও চবশরহম টহরাবৎংরঃু) এখন ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং-এ যথাক্রমে ১৭তম ও ২৩তম হয়েছে। কারণ চীন বুঝতে পেরেছে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে আগায়। তার আগে চীন এক সন্তান মডেল দিয়ে শুরু করে প্রথমে উড়ন্ত অর্থনীতির দুরন্ত ষধঁহপযরহম ঢ়ধফ তৈরী করেছে। একই সাথে শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ শুরু করেছে। দেখেন ৩০ বছরে চীন কোথায় চলে গেছে।
বাংলাদেশের জন্য চীন হতে পারে আদর্শ মডেল। কিন্তু আমাদের এত কাছের একটি দেশের এত বৈপ্লবিক উন্নয়ন দেখেও কিছু শিখি না। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি চীন স্টাডি, ভারত স্টাডি, জাপান স্টাডি ইত্যাদি নামে বিভাগ বা গবেষণা সেল আছে? অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ ভারত ও চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এইরকম দেশ ভিত্তিক গবেষণা সেল আছে যারা বীপষঁংরাবষু একটি দেশের নানা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে স্টাডি করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চীন ও ভারত স্টাডি গবেষণা সেল খোলা এখন জরুরি। চীনকে গভীরভাবে স্টাডি করে এর উন্নয়ন মডেলকে স্টাডি করে আমাদের উন্নয়ন মডেলকে সাজানো উচিত। এইসব না করে আমরা কি করছি? আমরা অর্থ ঋণ করছি, আমরা মেধা এবং প্রযুক্তি ধার করছি। এইসব ঋণ এবং ধার করে আমরা মেগা প্রজেক্ট বানাচ্ছি আর একই সাথে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে ডুগডুগি বাজাচ্ছি। আমাদের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন আর অবকাঠামোর উন্নয়ন বিপরীতমুখী ফলে এই উন্নয়ন কখনো টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাস দেখুন। পৃথিবীর যেই দেশই উন্নত হয়েছে সে প্রথমে মেধা তৈরী করেছে। সেই মেধা দিয়ে প্রযুক্তি বানিয়েছে। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রোডাক্ট তৈরী করে অর্থ বানিয়েছে। আমরা কি করছি? আমরা অর্থ, মেধা এবং প্রযুক্তি এই তিনটিই ঋণ করে উন্নয়নের গীত গাইছি। কতটা গাঁধা হলে এমন করতে পারি!
এই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক সত্যেন বোসের বোস-আইনস্টাইন তত্বের ১০০ বছর পূর্ণ হবে। সত্যেন বোসের এই কাজের মাধ্যমে কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্ম হয় বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জণ হলে। ভাবা যায় যে কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্মস্থান বাংলাদেশ! সারা পৃথিবীতে যারাই পদার্থবিজ্ঞানে আন্ডার গ্রাজুয়েট করবে তার জন্যই এই স্ট্যাটিসটিক্স পড়া বাধ্যতামূলক। আর আমাদের জন্য এটি জানা এবং বোঝার দায়িত্ব পৃথিবীর যেকোন দেশের শিক্ষার্থীদের চেয়ে একটু বেশি কারণ এর জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। এটিকে অজুহাত হিসাবে নিয়ে আমরা কি পারিনা সত্যেন বোসের নামে একটা ইনস্টিটিউট করতে? সেই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানাতে পারতাম কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্মস্থান বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে আমরা উন্নয়নের নতুন ধারার সূচনা করতে পারি। তবে এটি বাংলাদেশের অন্য ৫টা ১০টা ইনস্টিটিউটের মত হলে হবে না। এটিকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক ও শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ও গবেষক নিয়োগ দিতে হলে সেই মানের সমানুপাতিক বেতন স্কেল দিতে হবে। এছাড়া সেখানে অন্তত চার তারকা মানের গেস্ট হাউস থাকতে হবে যাতে আমাদের বাংলাদেশী যারা বিদেশের নামাদামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছে তারা বছরের অন্তত ৩টি মাস এখানে থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের গবেষণা শেখাতে পারে, পড়াতে পারে। এইরকম একটি প্রতিষ্ঠান দেখা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়