ভুল চিকিৎসা নিয়ে কিছু কথা
ফরিদা আখতার
হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের হাতে ভুল চিকিৎসায় বা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু নতুন কোন ঘটনা নয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই ঘটনা অনেক দেশেই ঘটছে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং এশিয়ার বড় বড় হাসপাতালে পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে সরকারী হাসপাতাল হোক বা প্রাইভেট ক্লিনিক কোথাও রোগীরা এমন ঘটনার শিকার হননি বলা যাচ্ছে না। তবে ইদানীং প্রাইভেট ক্লিনিকে এই ঘটনা বেশী শোনা যাচ্ছে। আবার সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে এমন ঘটনা ঘটলে রোগীর আত্মীয় স্বজনের প্রতিবাদ হচ্ছে আর চিকিৎসকরাও পালটা প্রতিবাদ করছেন। ফলে এখানে বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। মানুষ বুঝতে পারছে না তারা কার পক্ষ নেবেন। অসুখ হলে তো ডাক্তারের কাছেই যেতে হবে, আবার ডাক্তারকে অভিযুক্ত করে শাস্তি দিলে সকল ডাক্তার একত্র হয়ে যখন প্রতিবাদ করে তখন রোগীরা আরও অসহায় হয়ে পড়েন।
পাঠকদের মনে করিয়ে দেবার জন্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা আর একবার তুলে ধরছি। রাজশাহীতে ভুল চিকিৎসায় স্থানীয় ডলফিন ক্লিনিকে এক রোগীর মৃত্যুর মামলায় বিএমএ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বাচিপের সাংগঠনিক সম্পাদক শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুলকে ২৭ মার্চ কারাগারে পাঠায় আদালত। এর ফলে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসক, নার্স ও ক্লিনিক মালিকদের সাতটি সংগঠন ধর্মঘটের ডাক দেয়। সাতটি সংগঠনের দাবী করে ডাক্তার শামিউল আহমেদ শিমুলের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা বন্ধ থাকবে। তবে দুইজন চিকিৎসকের টিমের মাধ্যমে শুধুমাত্র রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এই সেবা যে যথেষ্ট নয় তার প্রমাণ ধর্মঘটের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আশরাফুল ইসলাম (৩৫) নামের একজন রোগী মারা যায় এবং শত শত রোগী ডাক্তারের অভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পায়। আশরাফুলের মৃত্যুর ঘটনা জনমনে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
আজকাল হাসপাতাল খুঁজতে হয় না, পথে ঘাটে, অলিতে গলিতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা কতখানি পাওয়া যায় তা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না। বড় বড় হাসপাতাল, যেগুলো দেখতে পাঁচ তারা হোটেলের মতো কিন্তু সেখানেও চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। রোগীর মৃত্যু সেটা স্বাভাবিক হলেও স্বজনেরা আবেগ আপ্লুত হন, সেখানে যদি কোন কারণে সন্দেহ জাগে যে কোন অবহেলা হয়েছে বা ভুল চিকিৎসা হয়েছে তাহলে ক্ষোভ প্রকাশের অবকাশ থাকে। এটা মেনে নেয়া যায় না। আরও মেনে নেয়া যায় না যখন একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিলে সকল চিকিৎসক জোট বাঁধেন এবং তাঁরা ধর্মঘট করেন। এতে যেসব রোগীর ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয়, তার দায়িত্ব কে নেবে?
রাজশাহীর ঘটনায় শুধু রোগী বনাম ডাক্তার নয়, আদালতও জড়িয়ে পড়েছেন। ডাক্তাররা ধর্মঘট ডেকেছেন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এবং অবিলম্বে শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুলকে মুক্তি দেয়ার দাবী তুলেছেন। বলা হয় কেউই আইনের উর্দ্ধে নয়, তাহলে আদালত অন্য মামলার আসামীদের যেমন কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দিতে পারেন তেমনি ডাক্তারের বেলায়ও পারার কথা। এটা আদালত এবং মামলার বিষয়, আমাদের সেক্ষেত্রে বলার সুযোগ কম। কিন্তু আদালত কি করেন তা দেখার বিষয়।
প্রশ্ন জেগেছে অনেক। একটা প্রশ্ন খুবই যুক্তিসংগত, সেটা হচ্ছে একজন ডাক্তারের ভুলের জন্য সকল ডাক্তারকে দায়ী করা ঠিক কি না। সেটা অবশ্য করা হচ্ছে না। তবে একজন ডাক্তারের প্রতি অভিযোগ উঠতে দেখে অন্যরা শংকিত হয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে যে তাদের প্রতি রোগীর আস্থা নষ্ট হচ্ছে। তাই কোন মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যদি ডাক্তারকে কারাগারে পাঠানো হয় তাহলে সেটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে যে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা হলে এভাবেই শাস্তি হওয়া উচিত। পরের প্রশ্ন হচ্ছে, চিকিৎসা ভুল নাকি অবহেলা, সেটা কে ঠিক করবে? এর মানদন্ড কি? আমি উইকিপিডিয়াতে ভুল চিকিৎসা খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি মেডিকেল এরোর যার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে, যে কোন স্বাস্থ্যসেবা দানকারী যদি কোন যথাযথ নয় এমন পদ্ধতি কিংবা যথাযথ পদ্ধতি অনুপযুক্ত ব্যবহার করেন, সেটা হবে চিকিৎসার দিক থেক ভুল। এবং শেষে বলা হচ্ছে এই ভুল চিকিৎস্রা জন্য চিকিৎসককে ইচ্ছাকৃত নয়, বরং মানুষ যেমন ভুল করে তেমনটাই গণ্য হবে। অর্থাৎ ডাক্তার ইচ্ছে করে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এমন কাজ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে না। এর ফলে মৃত্যু হলে সেটা তাহলে হত্যা মামলার পর্যায়ে পড়বে না।
আমি এখানে ভুল চিকিৎসা না বলে মেডিকেল এরোর সংজ্ঞার মধ্যে থেকেই কিছু আলোচনা করতে চাই। ইন্সটিটিউট অব মেডিসিন নামক একটি প্রতিষ্ঠান ২০০০ সালে গবেষণা করে দেখিয়েছেন প্রতি বছর মার্কিন দেশে ৪৪ হাজার থেকে ৯৮ হাজার রোগী মেডিকেল এরোর জনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন। এই গবেষণার অনেক সমালোচনা হয়েছে যে তারা কি করে জানলো যে ঠিকমত চিকিৎসা পেলেই এসব রোগীর শতভাগ বেঁচে যেতো! তবুও অন্যান্য গবেষণায়ও কোন না কোনভাবে দেখা যায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রতি ১০ হাজার রোগীর মধ্যে অন্তত ১জন হলেও আরও তিন মাস বেশী বাঁচতেন যদি তাঁর চিকিৎসা ঠিক মতো হোত। অর্থাৎ চিকিৎসার হেরফের হলে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর আগেও তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
ডাক্তারের ধর্মঘট বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে হয়েছে। এই মার্চ মাসেই ভারতের কানপুর জিএসভি মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারণে অন্তত ২০০ অপারেশন স্থগিত করতে হয়েছে। প্রিয়াংকা মিশ্র (২৬) নামের একজন রোগী তার নবজাত সন্তান হারিয়েছেন, চিকিৎসার অভাবে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকে ডাক্তারদের কাজে ফেরার নির্দেশ দেয়া হোল, নইলে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে। আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে দোষ যারই হোক, সাধারণ রোগীরা সকল ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এবং রাজ্য সরকার প্রায় ৪০ জন রোগী মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর এই পরিস্থিতির পুরো সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারী হাসপাতালগুলো, তাদের দালালেরা রোগী নিয়ে যাচ্ছে।
এই বছর জানুয়ারি মাসে নেপালে ডাক্তাররা ধর্মঘট করেছিলেন, দাবী ছিল মেডিকেল শিক্ষাকে স্বাধীন রাখতে হবে। প্রায় ৪ হাজার ডাক্তার এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। তাদের দাবী ভাল কিন্তু চিকিৎসা সেবা বন্ধের কারণে হাজার হাজার রোগী ভোগান্তির শিকার হয়। শুধু জরুরী বিভাগ ছাড়া সব বিভাগের চিকিৎসা সেবা বন্ধ। এখানে রোগীরা অনেক দূর, পাহাড়ী দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসে। কিন্তু সেবা না পেলে তাদের কি দশা হতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়। তবুও ডাক্তাররা তাদের ধর্মঘট অব্যাত রেখেছেন নিজেদের দাবী পুরণ হওয়ার আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত।
চিকিৎসক হওয়ার জন্যে যারা পড়াশোনা করেন তাদের মধ্যে মানবিক কার্যক্রমের সাথে নিজের জীবন উৎসর্গ করার একটা বাসনা থাকে। স্কুল জীবনে এইম ইন লাইফ রচনা লিখতে গিয়ে এই কথাটি প্রাধান্য দেয়া হোত। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ে যখন সত্যিই সেই মানব সেবা করার জন্যে নিযুক্ত হয় তখন তাকে একটি শপথ নিতে হয় যে তারা কারো ক্ষতি করবেন না বা তাদের দ্বারা কারো ক্ষতি সাধিত হবে না। ইংরেজীতে বলা হয় হিপোক্রেটিক ওথ, যা মুলত প্রথমে গ্রীক ভাষায় প্রণীত হয়েছিল খ্রস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে। অনেকে মনে করেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিপোক্রেট, কিংবা তাঁর শিস্যরা এই শপথটি লিখেছিলেন। এই শপথের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে কোন নতুন চিকিৎসককেই বেশ কয়েকটি নিরাময়কারী দেবতার নামে শপথ নিতে হয় এবং এর সাথে যুক্ত থাকছে পেশাগত নৈতিক দিক। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার এই শপথের ধরণ পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশ্ব মেডিকেল এসোসিয়েশন ১৯৪৮ যে পরিবর্তন আনে তার নাম দেয়া হয় ডিক্লারেশন অব জেনেভা। ১৯৬০ সালে হিপোক্রেটিক ওথকে পরিবর্তন করা হয় মানব জীবনের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মানের কথা বিবেচনায় রেখে। এর সাথে ধর্মের সম্পর্ক ছিন্ন করে একে ধর্ম নিরপেক্ষ করে দেয়া হয়।
ডাক্তারি পেশা অন্য সব পেশা থেকে ভিন্ন এই কারণে যে এর সাথে মানুষের শরীরের সাথে সরাসরি সম্পর্ক। অন্য পেশায় ভুল-ভ্রান্তি হলে আর্থিক বা অন্য ক্ষতি হতে পারে কিন্তু ডাক্তারের ভুলে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এবং হচ্ছেও তাই। তাই একজন ডাক্তার একটু ভাল করে কথা বললেও তাকে ফেরেস্তার সাথে তুলনা করে, আবার ভুল করলে তাকে কসাই নামে আখ্যায়িত করে। এটা সত্যি যে ডাক্তারি পেশার মানবিক দিক দিনে দিনে কমে গিয়ে ব্যাবসায়িক দিক বেশী প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই আর্থিক লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় ভুল-ভ্রান্তির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং কিছুটা অপরাধের পর্যায়ে চলে যাওয়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তাই হিপোক্রেটিক শপথ নেয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে অনীহা। আমেরিকায় ৯৮ শতাংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরা কোন না কোন ধরণের শপথ নেন, কিন্তু বৃটেনে মাত্র ৫০ শতাংশ শপথ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীরা এই শপথ নেন কিনা এই ধরণের কোন জরীপ নেই।
শপথ নিক বা না নিক, এই পেশার সেবার, পাশাপাশি আয় করাও, কিন্তু বাণিজ্যের নয়। এই বোধ মনে রেখেই চিকিৎসক হবেন। যারা সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেন, তাদের জন্যে যে বিশাল অংকের ভর্তুকী দিতে হয় তা একেবারে জনগণের পয়সা। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তারা পড়াশোনা করে জনগণের সেবা করবে বলে। তারা মানুষ ভুল ভ্রান্তি তাদের হতেই পারে কিন্তু সেই ভুল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানালে যদি সকল ডাক্তার কাজ বন্ধ করে দিয়ে নিরীহ ও মুমূর্ষ রোগীদেরও ভোগান্তি সৃষ্টি করে তখন মনে হয় ডাক্তারদের আচরণ সংক্রান্ত নীতি হওয়া দরকার। রোগীদের স্বজনরাও আবেগে ভাংচুর করছেন তাও সমর্থনযোগ্য নয় কারণ সেটা করে ডাক্তারের চেয়েও বেশী ক্ষতি অন্য রোগীদের। তবে এটাও বুঝি কারো মনে যদি সামান্য সন্দেহও জাগে যে ডাক্তাররের ভুল না হলে তার আপনজন মারা যেতো না, তাহলে তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝানো কঠিন ব্যাপার। যে হারায় সেই বোঝে বেদনা কত। এদিকে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আছে কি নেই এসব ঘটনায় তাদের কোন অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। বিএমডিসি দুদক ও নির্বাচন কমিশনের মতো নখ-দন্তহীন হয়ে বসে থাকলে ছোটখাট ঘটনাও বড় রূপ ধারণ করতে পারে। আশার কথা যে সরকার ভুল চিকিৎসার তদন্ত ও বিচারের জন্য নতুন বিধান সংযোজন করে বিএমডিসি আইনকে শক্তিশালী করার কথা সরকার বিবেচনা করছে। ভুল চিকিৎসা প্রমাণিত হলে চিকিৎসকদের সনদ বাতিলের জন্য ক্ষমতা দেয়া হবে।
আমাদের কথা চিকিৎসকদের শাস্তি দেয়া নয়, দেশের সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য যা করতে হয় সরকারকে সেটা করতে হবে। স্বাস্থ্য মানে শুধু চিকিৎসা নয়, স্বাস্থ্য মানে সুস্থ্ জীবন ব্যবস্থার সৃষ্টি করা। তার মধ্যে চিকিৎসা শুধু একটি অংশ মাত্র। লেখক : মানবাধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ে এক্টিভিস্ট