দেশের আবহাওয়া কেন উত্তপ্ত হচ্ছে? এ অবস্থায় আমাদের করণীয়
মিজানুর রহমান
দেশব্যাপী চলছে প্রচন্ড গরম। ঈদ ছুটি শেষ হতে না হতেই সপ্তাহব্যাপী মানুষের মুখে তীব্র গরমের কথা শুনা যাচ্ছে। দিন শুরু না হতেই ঝাঁজাল রোদ্দুর। মানুষ বাহিরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। বৈদ্যুতিক পাখা এ গরম সামাল দিতে পারছে না। এরি মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে। হিট এ্যালাট জারি হয়েছে। বেশি কষ্ট হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষদের। ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে হিট স্টোকে ২০ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুর খবর ও পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ও বাড়ছে। গত ২১ এপ্রিল আবহাওয়ার ফোরকাস্টিং থেকে জানা যায় দেশের কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির খবরে দেশবাসী শংকিত যেমন যশোর ৪২.৬০ চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৪০ রাজশাহী ৪১.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস একই দিনে সৌদি আরবে ৩৮ বাহরাইনে ৩২ কাতারে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের তাপমাত্রা সৌদি আরব থেকে ও বেশি। দেশের তাপমাত্রা এভাবে বেড়ে যাওয়াটা আমার ও কম দায়ি নই। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে কোন দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এ বছরের তথ্য মোতাবেক দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ। কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে বনভূমি উজার হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে উজাড় হচ্ছে সেভাবে বৃক্ষ রোপন হচ্ছে কি? নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, এক সময় এ দেশে ১ হাজার ৩০০ নদী ছিলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মোতাবেক এখন আছে ৪০৫টি, সেগুলো ও হজম করার পায়তারা হচ্ছে। খাল বিল জলাশয় ভরাট করে ফসিলি জমি ঘরবাড়ি করা হচ্ছে। বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই।
রাজধানী ঢাকায় অসহনীয় গরম পড়ছে। ঢাকায় নিজেদের ভোগবিলাস এর জন্য পরিবেশের উপর আমারা অনেক আঘাত হেনেছি। তথ্য অনুযায়ী গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ঢাকায় মাত্র ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় গাছপালা ও খালি জায়গা রয়েছে যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে জলাভূমি এলাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার। যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার। একটি আদর্শ শহরে ১৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জলাভূমি থাকার নিয়ম রয়েছে। অন্যদিকে বার বার চুয়াডাঙ্গায় কেন তাপমাত্রা বেশি থাকছে সেটা ও সবাই অবগত হলে বুঝতে বাকী থাকবে না নদী ও বনভূমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আছে।
এ মাসে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কেন সে জেলায় এত তাপদাহ? ভৌগোলিক দিক বিশ্লেষণ করলেই জানা যাবে এর কারণ কি? ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান সেই একই অবস্থানে আছে ভারতের রাজস্থান, সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমি গুলো অর্থাৎ এদেশগুলো একই অক্ষাংশে অবস্থান।
প্রশ্ন জাগে উল্লেখিত অঞ্চল সমুহে মরুভূমি হলে বাংলাদেশে কেন অমনটি নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ম্যাপে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে ম্যাপের মাঝামাঝি একটি রেখা অতিক্রম করেছে যার নাম হচ্ছে কর্কটক্রান্তি রেখা যা ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে। এই কর্কটক্রান্তি রেখাটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে প্রভাবিত করে। আমরা জানি পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। এ সরে যওয়ার কারণেই পৃথিবীর নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চল সরাসরি সূর্যের নীচে চলে আসে। যার কারণে উত্তর দিকের ২৩.৫ ডিগ্রি ও দক্ষিণ দিকে ২৩.৫ ডিগ্রির জায়গাটুকু সূর্যের সরাসরি নীচে অবস্থান করে। এ ২৩.৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের রেখাটি বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে অতিক্রম করেছে। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে ২১ মার্চের পর ধীরে ধীরে উত্তর অংশ সূর্যের নীচে অবস্থান করে।আর যেহেতু চুয়াডাঙ্গার উপর দিকে কর্কটক্রান্তি রেখাটি স্বাভাবিক ভাবে এ জেলার তাপমাত্রা অনুভূত হবেই। এ কর্কটক্রান্তি রেখা কিন্তু কুমিল্লা ও ফরিদপুরের দিক দিয়ে ও বিদ্যমান তাহলে সেখানে তাপমাত্রা তেমনটি নেই কেন? আমরা জানি জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে সমুদ্রের অবস্থান, প্রবাহিত নদী ধারার অবস্থান এবং ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। তিনটি বিষয় চুয়াডাঙ্গার অনুকূলে নেই। সমুদ্র থেকে আসা বায়ু প্রবাহের কারণে বায়ুমন্ডলে নিয়ন্ত্রণ করে যেমন অধিক শীতল আবার অধিক গরম হতে ও দেয় না। যার কারণে সমুদ্র তীরবর্তী জেলাসমুহ যেমন পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট এবং কক্সবাজারের আবহাওয়া খুবই সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ফরিদপুরের পাশে আছে বিশাল নদী কুমিল্লার পাশে আছে ত্রিপুরার বিশাল বনভূমি যা আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। চুয়াডাঙ্গায় নেই সমুদ্র, নেই নদী পথ, নেই বনাঞ্চল। সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১.৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। যার ফলে পানির লেয়ার ও অনেক নীচে অবস্থান করে। পানির লেয়ার নীচে থাকলে দ্রুত মাটি উত্তপ্ত হয়।
বাংলাদেশের সাথে একই অক্ষ রেখায় অবস্থিত ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমি এলাকা। ঐ এলাকাগুলো মরুভূমি হওয়া স্বত্বে ও বাংলাদেশের বেলায় তেমনটি না হওয়ার কারণ হল, আমরা জানি বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প উপকুলের দিকে ধাবিত হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এর জলীয়বাষ্প বাংলাদেশের উপর দিয়ে ধাবিত হলেই উত্তর অঞ্চলের হিমালয়ের পর্বতে ধাক্কা খেয়ে মেঘমালা তৈরি হয় এবং ধরণীতে বৃষ্টি নেমে আসে। এ সুবিধাটুকুত ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের বেলায় নেই। বলাবাহুল্য বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে চমৎকার একটি দেশ। এ কারণে বাংলাদেশে মরুভূমি হয়নি। এ উত্তপ্ত পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে চুয়াডাঙ্গা বাসীকে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে সবুজ শ্যামল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তখনই দেখা যাবে চুয়াডাঙ্গায় প্রচুর বৃষ্টি হবে সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে। সামগ্রিকভাবে তাছাড়া তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে হলে বনভূমি ধ্বংস না করি, ব্যক্তি স্বার্থে নদী ভরাট করা যাবে না নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে হবে।
এছাড়া কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস আমাদের বাতাসকে কুলসিত করছে। বাতাসের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতি যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে না আসে কি হতে পারে তা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান তাপদাহ থেকে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার ও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে, তাহলে পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষা পাবে। বর্তমান অবস্থান থেকে আমরাও পরিত্রান পাব। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট