ব্যাংকের মার্জার, একুইজিশন ও শেয়ারবাজার
কাজী এম মুর্শেদ
ব্যাংকের মার্জার ও একুইজিশন নিয়ে আবারও কিছু লিখছি। মারজার মানে একীভূতকরণ, দুই বোর্ড এক হয়ে যায়। আর একুইজিশন বা অধিগ্রহণ অর্থ এক বোর্ড বিলুপ্ত হয়। মার্জারে দুই ব্যাংক এক হলেও এসেট ও লায়াবিলিটিতে দুই ব্যাংকের সমান দায়িত্ব থাকে। সেটা অধিগ্রহণে থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় একীভূতকরণ বললেও মূলত এটা অধিগ্রহণ। অন্য ব্যাংকের বোর্ড বিলুপ্ত হবে, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট থাকতে পারবে না। এখন পর্যন্ত যে নয়টা ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে বিডিবিএল সোনালী ব্যাংকের সাথে, বেসিক ব্যাংক সিটি বাংকের সাথে, ন্যাশনাল ব্যাংক ইউসিবিএলের সাথে, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কৃষি ব্যাংকের সাথে, পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সাথে যাবে। হাতে এখনো বাকি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, আরব বাংলাদেশ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান। এর মধ্যে খবর হলো আলফালাহ ব্যাংক হয়তো ব্যাংক এশিয়ার সাথে যাবে। ব্যাংক এশিয়া আগেও ব্যাংক অফ নোভা স্কশিয়া নিয়েছে পরে মুসলিম ব্যাংক। বাকি চারটা ব্যাংকের নাম বললাম, সরকার হয়তো বোঝাপরায় আছে, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ও কমার্স ব্যাংক আর ওয়ান ব্যাংক নেবার জন্য দুই শক্ত ব্যাংক ব্রাক ব্যাংক ও ডাচবাংলার সাথে যাবার সম্ভাবনা আছে। তবে সাউথ বাংলার সাথে প্রিমিয়ার ব্যাংকও যেতে পারে, ওয়ান ব্যাংক সম্মন্ধে ধারণা করা কঠিন, তবে মেঘনা, মধুমতি, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকও হতে পারে।
ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তানকে হাবিব ব্যাংক বা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সাথে নিতে পারলে হয়তো আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের আইএফআইসির সাথে যোগ হবার সম্ভাবনা আছে। আরেকটা অপশন নিয়েও কাজ করতে পারে, কয়েকটা ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়, ইসলামী ব্যাংকের সাথে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং বিসিবিএলের একীভূতকরণ করা সম্ভব। ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি, এটা কমানো দরকার। সরকার সমমনা ট্রাস্ট ব্যাংকের সাথে কমিউনিটি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, আনসার ও ভিডিপি ব্যাংককে যুক্ত করতে পারে। আমি যে বড় সমস্যা দেখি তা হলো, দুর্বল ব্যাংকের ডিরেক্টর লেভেল অবলুপ্ত হবে, সেই সাথে ম্যানেজমেন্টের লিডারশিপ লেভেল থাকবে না, মানে এমডি থেকে এএমডি পর্যন্ত দরকার পরবে না। তারা ব্যাংক ছেড়ে অন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যেতে পারে বা উবার পাঠাও চালাতে বা কৃষিকাজে মন দিতে পারে।
মিড টিয়ারে কিছু কমবে এসইভিপি থেকে এভিপি, আর ব্রাঞ্চগুলোতে অনেকেই বেকার হবে, তবে নিচের লেভেল একই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ব্রাঞ্চ থাকলে তাদের ব্রাঞ্চ। সরকার যেখানে এতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা একবারে না করে ২ মাস পরপর করলেও বর্তমানের ক্রাইসিসের কারণ ঘটতো না। ইফেক্ট পরেছে, আমানতকারীরা তুলে নিয়ে তারল্য সংকট করে ফেলছে। …১৩ হাজার কোটি টাকা সাপোর্ট দেওয়া লাগলো, আর বেসিক ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকের অন্যতম শক্তি ছিলো বিটিআরসি যারা মোবাইল কোম্পানির কাছে তরঙ্গ নিলাম করে টাকা সেখানে রাখতো। তাদের জন্য ২ হাজার কোটি বড় ব্যাপার না, কিন্তু অন্য আমানতকারীরাও টাকা তুলেছে। সব ব্যাংক খারাপ না, সেটা বলেছি যেসব প্যারামিটার দিয়ে বিচার করে, সরকার অন্য ক্ষেত্রে করেছে। সেই হিসাবেই অনেক ব্যাংকেরই নাম আসেনি। আমার ধারণায় ইসলামি ব্যাংকগুলো ছাড়াও ক্ষমতাবানদের প্রভাবে অনেক দুর্বল ব্যাংকের নাম আনা হয়নি।
কমিউনিটি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক আছে। সেইসাথে এনআরবিসি ও এনআরবি ব্যাংক একীভূত করতে পারতো। জনগণের আমানত রক্ষা প্রথম কথা, সেইসাথে পাবলিক টাকা তুলে ঘরে রাখলে তারল্য সংকট হচ্ছে, তখন নিজেরা বাঁচতে ঋণ নিতে কলমানি রেট বাড়ানো, ডলার জমা করে টাকা ধারের সাথে সরকার থেকে উচ্চসুদে ঋণের প্রভাব সমস্যার হবে। আমানতকারীরা যে টাকা তুলছে, সেই প্রভাবের জন্যই নাম প্রকাশ না করে কে কাকে কেনার চেষ্ট করছে বলার দরকার ছিলো না। একই সাথে ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে গাড়ি কেনার লিমিট, অফিস সাজানোর বা আপ্যায়ন খরচ কমানো তেমন কোনো ইম্প্যাক্ট নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ সম্ভবত নিষিদ্ধ করেছে। কারণ তারা অগ্রিম তথ্য জানতে চায়। জানা ভালো। তবে পিড়াপিড়ির লক্ষণ দেখতে পারে। যেটা ভুল তথ্য হতে পারে। একটা ম্যাচিউরড অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হলো ব্যাংক বা ফিনানসিয়াল মার্কেট। অন্যটা শেয়ারবাজার বা ক্যাপিটাল মার্কেট যেটা অবস্থা বেশ খারাপ অবস্থায় চলছে। কর্মচারীদের রাখতে না পারলে অন্যপথ নেওয়া দরকার, অন্তত বেকারত্ব না বাড়িয়ে মেজর খাতগুলোতে নজর দরকার, নতুন করে বাড়তি বেতন বাড়লেও আর্থনীতির গুণগত বিচার করা হয়নি। সেইসাথে অনেকের নাম কেদ্রীয় ব্যাংক লিস্টে না দেওয়া ঠিক ছিলো না। শেষ করায় আগি দুইটা কথা। প্রথম হলো তাড়াহুড়া করে টাকা তোলার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্যাপিটাল মার্কেটের সূচকের পতন চলছে। এর কারণ বের করা দরকার। শেয়ারবাজার খালি করতে ব্যাংক নিয়ে সময় দেওয়া মানেই সামনে ক্যাপিটাল মার্কেটে যেন বড় কোনো ঝড় চলার লক্ষণ চলছে, সেটা লক্ষ্য রাখা দরকার। লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক