দূর্গাপুরের পাহাড়-টিলায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে
শাহীন খন্দকার : [১] বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার সুসং দূর্গাপুর সীমান্তবর্তী উপজেলার পাহাড় টিলায় বসবাসরত জনগোষ্ঠির জন্য চৈত্র-বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য মাস তীব্র পানি সংকটে দিন অতিবাহিত করে আসছেন, সেই আদীকাল থেকেই। এই অঞ্চলে পাহাড়-টিলার বসতীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর পানির তীব্র সংকট বেড়েছে।
[২] তীব্র দাবদাহে সেই সংকট যেনো আরও বেড়েছে। পাহাড়ী জনপদে প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন বিশুদ্ধ পানির হাহাকার চলছে। পাহাড়ি ঝরনা বা ছড়ার ময়লাযুক্ত পানি ও সোমেশ্বরী থেকে বয়ে যাওয়া খালের ঘোলা পানিই এখন একমাত্র ভরসা। দুর্গাপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে দুর্গাপুর সদর ও কুল্লাগড়া ইউনিয়ন ভারতীয় সীমান্ত মেঘালয়ের পাহাড়ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানকার ১০-১২টি গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো-হাজং,হুদি সম্প্রদায়ের বসবাস।
[৩] এই পাহাড়-টিলায় বসানো যাচ্ছে না পাথর ও বালুকুচির জন্য টিবউয়েল। ফলে বর্ষায় ভরসা সোমেশ্বরীর জল আর চৈত্র-বৈশাখে ভরসা ঝর্ণার জল নয় এযেনো অমৃত সুধা! পাহাড়ি ঝরনা, ছড়া ও পুকুরের দূষিত পানি দিয়ে শেষ করতে হচ্ছে রান্না-গোসলসহ প্রকৃতির কাজ। খেতেও হচ্ছে ওই সংগৃহীত জল, ফলে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত রোগ। বর্তমানে ওইসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের কষ্ট এখন চরম আকার ধারণ করেছে।
[৪] এ নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদর ইউনিয়নের গোপালপুর, ভবানীপুর, ফান্দা, বারোমারী, ভরতপুর, গাজিকোনা ডাহা-পাড়া,বাদামবাড়ী টাকশাল পাড়া, রাঙাঝরা গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় শুকনো মৌসুমেও দেখাদেয় পানির তীব্র সমস্যা।
[৫] স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে একদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে পানি সংকট। অন্যদিকে নলকূপ বসানো যায় না পাহাড় টিলায় পাথরকুচি থাকায়। এজন্য তাদের বাধ্য হয়েই পুকুর বা পাহাড়ি ছড়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে পেটের নানা অসুখসহ চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ওই গ্রামগুলোতে দিন আনে দিন খায় এমন হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের পক্ষে গভীর গভীর কূয়া তৈরি করা সম্ভব নয়। গ্রামে দু-একজন অধিক অর্থ ব্যয় করে সাবমারসিবল বসালেও বেশিরভাগ মানুষের ভাগ্যে জুটছে না বিশুদ্ধ পানি।
[৬] চাকের রিং বসিয়ে অ-গভীর কুয়া তৈরি করে খাবার পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমে সেখানে পানি থাকে না। কোনোটাতে পানি থাকলেও তা খাওয়ার অনুপযোগী। পানি দূরদূরান্ত থেকে কাঁধে করে বয়ে এনে পান করতে হয় বিশুদ্ধ পানি। দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের ডাহাপাড়া গ্রামের কবিলা রুংদী বলেন, কি করতাম আমরা গারো মানুষ ঝড়ার (চি-ইআরার ভরসা) চি মানে পানিই আমাদের ভরসা।
[৭] ভরতপুর গ্রামের আদিবাসী বুবু মারাক জানান, তার বাড়িতে নলকূপ না থাকায় (চি) পানির জন্য সারা বছরই কষ্ট করতে হয়। আমরার কল (টিউবওয়েল) নাই। আরার অনেক আগে থাইকা পাহাড়ের ঝড়না বা ছড়ায় যে পানি আছে ওইডাই খাই। রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করি। গ্রামের সবারই একই অবস্থা।
[৮] এদিকে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসা রেগুলার মানকিন বলেন, আমাদের সু-পেয় পানির খুবই অভাব। পাহাড়ি ছড়ায় গর্ত করে সে জায়গা থেকেই পানি সংগ্রহ করি আমরা। কিন্ত এই পানি বিশুদ্ধ না হওয়ার নানা রকমের রোগের দেখা দেয় সব সময়-ই। আমাদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি। [৯] দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোতে গভীর টিউবওয়েল বসাতে হলে পাথর সরিয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ’শ ফুট নিচ পর্যন্ত যেতে হয়। তার জন্য খরচ অনেক ব্যয়বহুল, যা সেখানকার মানুষের পক্ষে জোগানো কষ্টসাধ্য। তবে বিকল্প হিসেবে গভীর রিং টিউবওয়েল বসানো যায় তাহলে পাহাড়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সু-পেয় পানির সমস্যা কিছুটা দূর হবে।
[১০] এ ব্যাপারে দুর্গাপুর উপজেলা জনস্বাস্থধ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, পাহাড়ি এলাকায় পাথরের জন্য গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। ওই এলাকায় পানি সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এই পানির সংকট দূর করতে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতে চাচ্ছি। উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করবো।
[১১] এ নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম রকিবুল হাসান বলেন, পানির সংকটের করতে ও ওই গ্রামগুলোতে সু-পেয় পানির ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানোও হয়েছে। আশা করছি বিষয়টি নিরসন হবে।
[১২] এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী জানিয়েছেন, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার জনস্বাস্থ্যকর সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্ব-স্ব মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। তিনি আশাবাদী দ্রুত চলমান এই জনপদে সুপেয় পানী সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।