স্বপ্নবান ভালো শিক্ষক নিয়োগ না কারিকুলাম পরিবর্তন?
ড. কামরুল হাসান মামুন
দেশে যে একটা নতুন শিক্ষাক্রম নাজিল হলো এর কারিগর কারা? কাদের দাবির প্রেক্ষিতে এই শিক্ষাক্রম চালু হলো? শিক্ষকরা আগের কারিকুলাম নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন? তারা কি কারিকুলাম বদলানোর দাবি করেছিলেন? অভিভাবকরা কি কারিকুলাম বদলানোর দাবি করেছিলেন? ছাত্ররা কি কারিকুলাম বদলানোর দাবি করেছিলেন? তাহলে কাদের দাবির প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পুরো কলেবর বদলে ফেলা হলো? পৃথিবীতে এমন নজির কোথাও আছে যেখানে বিদ্যমান কারিকুলাম, মূল্যায়ন ও পরীক্ষা সিস্টেম একসঙ্গে শতভাগ বদলে ফেলেছে? নতুন যেই কারিকুলাম নাজিল হলো এটি কেমন? তার আগে বলে নেই শিক্ষার মানের পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্ত কী? সেটা হলো শিক্ষকের মানের পরিবর্তন। শিক্ষকের মানের পরিবর্তনের প্রথম শর্ত হলো এই পেশাকে আকর্ষণীয় করা যাতে বাবা-মা থেকে শুরু করে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়। এই স্বপ্নবান ছেলেমেয়েরা তাদের অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন নিয়ে যখন শিক্ষক হবে তারা পারবে আমাদের আগামী প্রজন্মের মাঝে স্বপ্নের বীজ বপন করতে। স্বপ্নবান শিক্ষক দিলে কারিকুলাম যেটাই হোক তাদের সান্নিধ্যেই ছাত্রছাত্রীরা স্বপ্ন ও আদরের পরশে বদলে যাবে। তাহলে কোনটা জরুরি ছিল? স্বপ্নবান ভালো শিক্ষক নিয়োগ না কারিকুলাম পরিবর্তন? ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আজকে অদলবদল করলাম। দেখবেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান মূলত নির্ভর করে শিক্ষকদের মানের উপর। আমাদের দেশের আমলা মন্ত্রীরা এই সামান্য বিষয়টাই উপলব্ধি করতে পারে না। অথচ তাদের হাতে ক্ষমতা। অযোগ্যদের হাতে ক্ষমতা গেলে যা হয় শিক্ষা নিয়ে এখন তাই হচ্ছে। সরকারের যে শিক্ষার মান উন্নয়ন আসল উদ্দেশ্য না সেটা বুঝতে কি অনেক জ্ঞানী হওয়ার দরকার আছে? মোটেও না। শুধু নিরপেক্ষ ও দেশপ্রেম নিয়ে একটু ভাবনার ক্ষমতা থাকলেই চলে। এই শিক্ষাক্রম যে কতটা ভয়ানক ক্ষতিকর সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই বুঝে। কিন্তু প্রমোশন ও পদ-পদবি না পাওয়ার ভয়ে কেউ কথা বলছে না। এর মধ্যে একটা আশার আলো হলো একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অমিতাভ রেজা চৌধুরী কথা বলেছেন। তিনি নতুন শিক্ষাক্রমের কুফল অনেকটাই বুঝতে পেরেছেন। আর দেশে এত এত ছাত্র সংগঠন ছাত্র রাজনীতি করলেও কেউ এইটা নিয়ে কিছু বলছে না। বিশেষ করে বড় দলগুলোতো একেবারেই না। আর শিক্ষকরা যারা রাজনীতি করেন তারাতো আরো না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষাক্রম নিয়ে আমরা একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলাম কিন্তু শেষ মুহূর্তে কর্তৃপক্ষ উপরমহলের এক ফোনের কবলে পরে আমাদের অনুষ্ঠানটি পূর্বানুমতি থাকা সত্ত্বেও বাতিল করে দেয়।
অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে সবাই গর্ব করে গবেষণা ও শিক্ষার মানের জন্য যতটা না তার চেয়ে অনেক বেশি গর্ব করে দেশ ও সমাজ নিয়ে এর প্রতিবাদী রূপের কারণে। দেশ ও সমাজ নিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য একে ৭৩ এর অধ্যাদেশ দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়। অথচ সেটাও আজ অকার্যকর। তারপরেও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টকে ধন্যবাদ তারা এগিয়ে এসেছে। তারা গণস্বাক্ষর অভিযানে নেমেছে। দেশের সকল মানুষের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের পাশে দাঁড়াতে আপনাকে তাদের রাজনীতি করতে হবে না। শুধু দরকার একটু দেশপ্রেম। ধন্যবাদ অমিতাভ রেজা এই বিষয়ে কথা বলার আকালের দিনে আপনি এগিয়ে এসেছেন। লেখক : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়