শেয়ারবাজার কি আবারও বড় অভিঘাতে বিপর্যস্ত
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আরও একবার বড় ধরনের সংকটের মাঝে অবস্থান করছে। বলা হচ্ছে পরিস্থিতি ঠিক ২০১০ সালের মতো কিংবা ১৯৯৬-৯৭ সালের মতো। কেউ কেউ বলছেন, পরিস্থিতি আসলে ২০১০ থেকেও খারাপ। কারণ ২০১০ সালে এক রকম উচ্চ পর্যায়ে থেকে বাজারটি পরে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন বাজারটি দীর্ঘদিন ধরে নিচের অবস্থানে আছে এবং সেখান থেকেই পড়ে যাচ্ছে। বর্তমান শেয়ারবাজার নিয়ে বলা হচ্ছে সব শেষ এখন। কারণ বাজারে সেই অর্থে কোনো পুঁজি বা বিেিয়াগকারী নেই। কিছু ব্রোকার আছে, কিন্তু পেছন থেকে কারসাজি করে পুরো বাজারটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে এখন সেটিকে বাজার বলা যাচ্ছে না।
অবিবেচক ধরনের লোকজন বিএসইসিতে থেকে পুরো বাজারটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অবস্থা এতই খারাপ যে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন ঠেকাতে মূল্যসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিএসইসি এবং তারা বলছেন, এখন থেকে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম একদিনে ৩ শতাংশের নিচে নামবে না। এই যে নির্ধারিত করে দেওয়া এটি আসলে মার্কেট কারেকশন। কিন্তু মার্কেটে কারেকশন করে এটিকে আসলে স্থির অবস্থায় আনা যায় না। এর আগে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিলো বিএসইসি। তাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট সীমার নিচে নামার সুযোগ ছিলো না। বেশিরভাগ শেয়ারের লেনদেন তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সমস্যাটি আসলে কোথায়? আমাদের শেয়ারবাজারে কোনো স্থিরতা নেই। শেয়ারবাজারে মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মাধ্যমে। প্রতিটি লেনদেনে এসব হাউজ কমিশন পায়। একটি বড় সমস্যা হলো শেয়ারবাজারকে অনেকে দৈনন্দিন উপার্জনের মাধ্যম মনে করেন। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় সমস্যা তৈরি করে রেখেছে আমাদের বাজারে। যারা অল্প টাকা নিয়ে বা ঋণ করে বাজারে আসছে তারা বাজারের বড় ধরনের জটিলতায় পড়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে বাজারে অস্বাভাবিক দর পতন হলে, তখন থেকে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছে এবং শেয়ারবাজারের একটি বড় অংশ ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে। শেয়ারবাজার অস্থিরতার বড় একটি কারণ হচ্ছে এই ঋণ নির্ভরতা। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যারা টাকা খাটায়, তাদের সেই অর্থে কি বিনিয়োগকারী বলা যায়? বলা যায় না। বিনিয়োগের সুফল পেতে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন যা অনেকেরই নেই। যার ফলে বাজার নিম্নমুখী হলে তারা আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যান যার প্রভাব বাজারে আরও খারাপ ভাবে পড়ে।
আমাদের শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগটি বেশ পুরোনো। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই আমলেই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। ৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ভিত্তিতে ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো, কিন্তু সেসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। শুধু একটি মামলায় ট্রাইবুনাল দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছিলো। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতনের পর সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো এবং তার প্রধান করা হয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে। ইব্রাহিম খালেদ তখন বেশ পরিষ্কার করেই বলেছিলেন যে, একটি মহলের কারসাজির কারণে শেয়ারবাজার তখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো। যদিও সরকার সে তদন্ত রিপোর্টটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।
বর্তমানে একদিকে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দর পতন হচ্ছে, অন্যদিকে কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম। বিএসইসি সেখানে কিছুই করছে না বা করতে পারছে না। পুঁজিবাজারের পতনের জন্য বিএসইসিকেই বিনিয়োগকারীরা দায় করছেন। বিএসইসি তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং ব্যর্থ হলেও দেখা যাচ্ছে যে এখানে কোনো নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটছে না। আমি সাংবাদিক হলেও বলবো বিএসইসির এমন ব্যর্থতার সঙ্গী হয়েছে কিছু সাংবাদিক এবং সম্পাদক। তারা বিএসইসির পয়সায় বিদেশ ঘুরেছে, নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। তারা শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো ধরনের গঠনমূলক আলোচনা কখনো করেনি। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ভালো না হওয়ার পেছনে কারণ হলো যারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করে তারাই ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াজ রেজার ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস