হিটস্ট্রোক, সামাজিক দ্বান্দ্বিকতা ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই
আহসান হাবিব
[১] এখন দুঃসহ গরম চলছে, মানুষের নাভিশ্বাস উঠে পড়ছে। হিটস্ট্রোকে মানুষ মারাও যাচ্ছে। এই যে এতো তাপমাত্রা, এর জন্য কে দায়ী? যারা এর শিকার, তারা দায়ী নয়। কিন্তু যারা দায়ী তারা এর কুফল ভোগ করছে না, তারা দিব্যি আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। তাদের গায়ে তাপের আঁচড় লাগছে না একরত্তি। এটাই এই সমাজব্যবস্থার এক করুণ দ্বান্দ্বিকতা। [২] কোন সমাজব্যবস্থা? পুঁজিবাদী। এই ব্যবস্থায় প্রধাণত দুটি শ্রেণী: পুঁজিপতি এবং শ্রমিক। শ্রমিকের শ্রমশক্তি ছাড়া পুঁজিপতি একটিও পণ্য তৈরি করতে পারবে না, ফলে মুনাফা বা উদ্বৃত্তমূল্যের কানাকড়িও আত্মসাৎ করতে পারবে না। সবকিছু করবে শ্রমিক তার শ্রমশক্তি দিয়ে কিন্তু সেসব ভোগ করতে পারবে না, করবে পুঁজিপতি। এই যে বৈপরীত্য, এটাই এই সমাজের দ্বান্দ্বিকতা। যে উৎপন্ন করবে, সে ভোগ করবে না।
[৩] প্রকৃতির তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী অনেককিছু, তারমধ্যে প্রধান হচ্ছে ফসিল ফুয়েলকে পোড়ানো। এর ফলে তৈরি হয় যে বিবিধ গ্যাস, তার আধিক্য এই অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য দায়ী। কী করে এই গ্যাসগুলো? সূর্য থেকে আসা তাপকে এই গ্যাসগুলো আটকে ফেলে, ফেরত যেতে দেয়না। এই ফেরত যেতে না পারা তাপমাত্রা স্বাভাবিক আবহাওয়াকে বদলে ফেলে, তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীতে যতো গাছপালা, সমুদ্র তা এই অতিরিক্ত গ্যাসকে শোষণ করতে পারে না। এটি তার সীমার বাইরে, ফলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এর জন্য দায়ী তাহলে কে? পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। কেন? কারণ পুঁজিবাদ যে উন্নয়নের কথা বলে, তা আর কিছুই নয়, প্রকৃতির সাম্যাবস্থাকে নষ্ট করে কৃত্রিম একটা প্রকৃতি তৈরি করে। এই কৃত্রিম প্রকৃতির মধ্যে আমরা বাস করি। আমরা এর থেকে বেরুতে পারিনা, তাপের মতো আটকা পড়ি। বিদ্যুৎ বানাই, এর মাধ্যমে মানুষের তথাকথিত যা কিছু আরামের জন্য প্রয়োজন তা তৈরি করি। এটা করতে গিয়ে ফসিল ফুয়েলকে পোড়াতে হয় অবিরাম যার ফলশ্রুতি এইসব গ্যাস। এই গ্যাসগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে যে শক্তি তার নাম বিদ্যুৎ যা এনার্জি হিসেবে আমরা ব্যবহার করি। এই বিদ্যুৎ তৈরি করতে আমরা ফসিল পোড়াই, জল ব্যবহার করি, পরমাণুকে কাজে লাগাই। এইসব কিছু মিলে পৃথিবীর স্বাভাবিকতাকে বদলে কৃত্রিম করে ফেলি যার ফলশ্রুতি এই তাপদাহ।
[৪] তাহলে কী মানুষ এইসব করবে না? করবে, অবশ্যই করবে। তবে প্রকৃতির ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে যা কিছু করা হবে, তার ফল ভোগ করতে হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত যা করেছে তা ভারসাম্যকে শুধু নষ্ট নয়, ধ্বংসের কিনারে নিয়ে গেছে। টিকে থাকার সীমা অতিক্রমণের পথে। পুঁজিবাদ এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। এটা করতে গিয়ে তার দরকার হয় ক্ষমতা, যে ক্ষমতার ফলে সে রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করে। এর মধ্য দিয়ে এক অমিমাংসেয় দ্বন্দ্ব বজায় রাখে। আমরা এর ভেতরে হাঁসফাঁস করতে থাকি, মুক্তি পাই না। পুঁজিবাদ তার আধিপত্য বজায় রাখতে এমন কিছু নেই যা সে করে না। মারণাস্ত্র একটি হাতিয়ার যা দিয়ে সে সবমসময় পৃথিবীতে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখে। যুদ্ধ শুধু পরিবেশ নয়, সারা পৃথিবীকেই ধ্বংস করার দিকে এগিয়ে নেয়।
[৫] এখান থেকে মুক্তির একটাই পথ- পুঁজিবাদকে পরাস্ত করা। পরাস্ত করার অর্থ হলো এর যে বৈষম্যমূলক দ্বন্দ্ব তার মিমাংসা করা। মিমাংসা মানে ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপ। এর ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে দ্বন্দ্ব তার বিলোপ। যখনি এটা ঘটবে, তখনি কেবল ভোগের সাম্য ফিরে আসবে এবং তা হবে প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত। জানি, এসব এখন কল্পনার মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু সত্য হচ্ছে মানবপ্রজাতিকে টিকতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। মানুষ যে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে গাছ লাগাকে একটা মহা উপায় ভাবছে, তা তার স্রেফ বোকামি। এর মূল কারণ নিয়ে যতোক্ষণ সে পথে নামছে এবং পুঁজিবাদকে পরাস্ত করছে, পরিত্রাণ নেই। এই পৃথিবী ধ্বংসের কারণ, সূর্যের জ্বালানি ফুরিয়ে নিভে যাওয়া নয় বরং তার আগেই এই কাজটি করবে পুঁজিবাদ। গাছ লাগানো একটা পুঁজিবাদী চালাকি, মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়াই তার চালাকি। বৃষ্টির জন্য কান্না একটি পরিত্যক্ত যাদু এবং ধর্মের গোঁজামিল। এর ফলে মানুষের বোকামির ফল পুঁজিবাদ তুলে নেয়। [৬] আসুন, লড়াই করি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধ। লেখক : ঔপন্যাসিক