বিশ্বে চলছে কারেন্সি যুদ্ধ! বাংলাদেশের প্রেক্ষিত কেমন হতে পারে?বিশ্বে চলছে কারেন্সি যুদ্ধ! বাংলাদেশের প্রেক্ষিত কেমন হতে পারে?
ওয়াসী মাহিন
বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এবারের বিশ্বযুদ্ধ যতটা না অস্ত্রের তার থেকেও বেশি অর্থনীতির ও রাজনৈতিক প্রভাবের। চলমান বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনীদের দুর্বল হবার সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গতবছর সুইফট স্যাংশন ও ডলারকে ওয়েপন হিসাবে বড় শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাবহারের পর বেশ কয়েকটি লেখায় বিস্তারিত বলেছিলাম। অনেকেই দ্বিমত করেছিলেন যে ডলারের কিছুই হবেনা। ডলার বৈশ্বিক কারেন্সি হবার জন্য যে জিনিসটি কাজ করেছে সেটি হল গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা। ডলারকে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করার সিদ্ধান্ত ডলারের গ্রহনযোগ্যতা ও আস্থা দুটিতেই বড় আঘাত করেছিল। এর প্রভাব এখন স্পষ্ট হচ্ছে।
ডলার নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া যেমন সরব বিশ্বের সব দেশ এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ডোনাল্ড ট্রাম্প মাস খানেক আগে বলেছিলেন বাইডের সরকারের অধীনে ডলারের পতন হলে সেটা হবে বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে আমেরিকার সবথেকে বড় পরাজয়। কেন সবাই উদ্বিগ্ন? একক বৈশ্বিক ফিয়াট কারেন্সি হিসাবে ডলারের গ্রহনযোগ্যতা ও আস্থা আমেরিকাকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। টেকনিক্যালি যেহেতু আমেরিকার ডেট আমেরিকার নিজস্ব মুদ্রা ডলারে নির্ধারিত তাই আমেরিকার দেউলিয়া হবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে পরিস্কার করি। বাংলাদেশ সরকারের যত দায় এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋনের জন্য কখনোই দেউলিয়া হবার সুযোগ নেই। আর এজন্যই দেশীয় বাজার থেকে যেমন ব্যাংক থেকে বা সঞ্চয়পত্র বা ট্রেজারি বিল বিক্রি করে প্রতি বছর লাখ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট দিলেও ডিফল্টের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। ডিফল্টের ঝুঁকি থাকে বৈদেশিক ঋনে। সেখানে ডলারে পেমেন্ট করতে হয়। আর ডলার আমাদের নিজস্ব মুদ্রা নয়। আমাদেরকে আয় করে বা যোগার করে তবেই দায় পরিশোধ করতে হয়। আমাদের রিজার্ভের উপরেও এর চাপ পড়ে।
আমেরিকার ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেকটা এদেশের অভ্যন্তরীণ ঋনের মত। যেহেতু তাদের নিজস্ব মুদ্রা ডলার তাই তাদের টেকনিক্যাল ডিফল্ট করার সুযোগ খুব সীমিত। কিন্তু বিষয়টি কি এতটাই সহজ? আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক।
বিশ্বে পরাক্রমশালী বলে কিছু নেই। শক্তিশালী দেশ বা সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ থাকে। কিন্তু কোন না কোন সময় পতন হয়। সেটা ১০০ বছর পর হোক বা হাজার বছর পর। আমেরিকার শক্তির প্রধান উৎস যদি ধরা হয় তাহলে তিনটি জিনিস আসে। ১. ডলার। ২. সামরিক সক্ষমতা ৩. সফট পাওয়ার যেটা জাতিসংঘের প্রভাব, মিত্রদেশ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাটো এসবের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়।
ক্ষমতা স্পর্শকাতর বিষয়। ক্ষমতার সাথে দায়িত্ব জড়িত। কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকে ধাবিত করতে পারে। বিগত অর্ধ শতাব্দিতে আমেরিকা মোটামুটি তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে ফেলেছে। সামরিক শক্তির অপব্যবহারে বহু দেশের ক্ষমতা বদল ও আক্রমন করা হয়েছে। নিজেরা মানবতার আলোকবর্তিকা নিয়ে ঘুরার প্রচার করলেও সাদ্দাম হোসেনকে প্রশ্নবোধক বিচারে ফাঁসিতে ঝূলানো, মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা সবখানেই তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতি ১০টি দেশের একটি দেশ কোন না কোন ভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে।
কিন্তু সর্বশেষ ডলারকে যখন মার্কিনিরা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করল তখন মোটামুটি সবথেকে বড় ব্যাক বাইট তাদের সহ্য করতে হল। প্রথমত বিশ্বের মোট বাণিজ্যের এক দশমাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হলেও বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ সম্পাদিত হয় ডলারে। বিশ্বের রিজার্ভ কারেন্সিতে ডলারের প্রভাব সবথেকে বেশি। ডলারের ক্ষমতা ও মূল্য ধরে রাখার ক্ষমতা রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলারকে অটোচয়েস করেছে। আর একারনেই অর্থনীতিতে একচ্ছত্র সফট পাওয়ার হয়ে উঠে আমেরিকা। বিশ্ব বাণিজ্য ও রিজার্ভ কারেন্সিতে ডলারের প্রভাবের কারনে প্রতিটা মার্কিন মনিটরি পলিসি বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে বা পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। অর্থাৎ মার্কিনিরা নিজেদের পলিসিতে পরিবর্তন এনেই বিশ্বের অন্য প্রান্তের কোন দেশের অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
কিন্তু ঝামেলা বাধে বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার রিজার্ভ আটকে দেয়ার পর। ৬০০ বিলিয়নের রুশ রিজার্ভ হুমকিতে পড়লে টনক নড়ে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই। ডলারে রিজার্ভ রাখাটা অনিরাপদ মনে করে থাকে অধিকাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংক। শুধুমাত্র গত বচজরেই জাপান ও চীন ইউএস ট্রেজারী থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে এনেছে। এটা আমেরিকার সামরিক বাজেটের অর্ধেক। বৈশ্বিক কারেন্সি আমেরিকার নিজস্ব মুদ্রা ডলার হবার কারনে আমেরিকা বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি বা বাজেট ঘাটতি এনজয় করতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি আমেরিকা থেকে এভাবে ডলার সরিয়ে নেয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়েছে আমেরিকা। দেশটি মাত্র ২০ বছর আগেও জিডিপির ৬০ শতাংশ ছিল ডেট। সেটি এখন ১৩০ শতাংশ এ পৌছেছে। বর্তমান $৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে সেটা ২০২৭ সালেই ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও প্রভাব খাটাতে সম্পদের অপব্যবহার করা আমেরিকাকে ভোগাতে পারে। বাংলাদেশের রিজার্ভের বিশাল অংশ আমেরিকায় ফেডারেল রিজার্ভে রয়েছে। এরকম প্রতিটি দেশের রিজার্ভের সংহভাগ আমেরিকার কাছে। এগুলা আমেরিকার জন্য ডেট। যদি দেশগুলি রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলারের অংশ কমিয়ে আনে তবে আমেরিকার অর্থনীতি বড় ঝুকিতে পড়বে।
প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও বিশ্বের অধিকাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংক গত বছর ডলারকে পাশ কাটিয়ে গোল্ড রিজার্ভের পরিমান বাড়াতে থাকে। স্বর্নের মাসিক চাহিদার ৩৩ শতাংশ ছিল সেন্ট্রাল ব্যাংক গুলির। যেটা ১৯৫০ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ গোল্ডের বেচা কেনার এখন ৩৩ শতাংশ সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো করছে। অধিকার সেন্ট্রাল ব্যাংক তাদের গোল্ড রিজার্ভ বাড়াচ্ছে যার মধ্যে রাশিয়া ভারত ও চীন বাড়িয়েছে সবথেকে বেশি।
এরপর আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। সেটি হল কারেন্সি সোয়াপ। কিছুদিন আগে একটা লেখায় শেয়ার করেছিলাম রুপপুরের ঋণের টাকা বাংলাদেশ ইউয়ানে পরিশোধ করবে। এর পর পরেই আমেরিকা থেকে অপ্রত্যাশিত চাপ আসে যেন ইউয়ানে পরিশোধ না করা হয়। তারা বিশেষ ভাবে চাইনিজ এরেঞ্জমেন্টে ঋণ পরিশোধের বিরোধিতা করে। প্রয়োজনে তারা বিকল্প ভাবে বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধে সাহায্য করবার প্রস্তাবো দেয়। এই বিষয়টা পরিস্কার করে আমিরকা কতটা প্যানিকড। বিশেষ করে ইউয়ানের উত্থানে।
কারেন্সি সোয়াপটা একটু ছোট করে বলা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংক শ্রীলঙ্কাকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। কারেন্সি সোয়াল এগ্রিমেনটের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা ২৫০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কান মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখবে। এখন প্রশ্ন হল যদি দেশটির মুদ্রার মান কমে যায় তখন কি হবে? এক্ষেত্রে সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে আপটুডেট বিনিময় হার অনুযাযী শ্রীলঙ্কা অতিরিক্ত মুদ্রা জমা করবে।
এবার আসা যাক ভারত, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ মুদ্রা হবার বর্তমান অবস্থা। ভারতের রুপিতে প্রায় ১৯টি দেশ ট্রেড করতে সম্মত হয়েছে। কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমেই ইন্দোনেশিয়া তাদের রুপাইয়াকে বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়া, চীন বাদে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার এরকম সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক লেনদেনে ডলারের প্রভাব কমাতে যথেষ্ট সাহায্য করবে।
আগের পোস্টে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশ রাশিয়ার ঋণ ইউয়ানে শোধ করলে এত ইউয়ান কোথায় পাবে? আমাদের তো ডলার দিয়েই ইউয়ান কেনা লাগবে তাইনা?
উত্তর হল না। চীন চাইছে ডলারের প্রভাব কমাতে। ডলার দয়ে ইউয়ান কিনলে তাইলে ইউয়ানে ব্যাবহারে আগ্রহী হবে কেন বিভিন্ন দেশ? ইউয়ান এখনো ডলারের মত স্টাবল কারেন্সি নয় যদিও আইএমএফ এর কারেন্সি বাস্কেটের একটি মুদ্রা ইউয়ান। বাংলাদেশ মুলত চীনের সাথে টাকা -ইউয়ান কারেন্সি সোয়াপ করবে। এতে চীনের একাউন্টে বাংলাদেশ টাকা জমা করে ইউয়ান নিবে। এক্ষেত্রে ডিফল্ট ঝুকি কিভাবে কমে সেটা উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
একইভাবে ভারতের সাথেও বাংলাদেশ কারেন্সি সোয়াপ করবে। তবে এক্ষেত্রে হিসাব একটু ভীন্ন। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির যেই অংশ শুধুমাত্র সেই অংশটুকু টাকায় ও রুপিতে নিষ্পত্তি হবে। তবে মূল কথা ইউয়ান ও রুপিতে কারেন্সি সোয়াপ ভবিষ্যতে টাকাকেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে আগের থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য কারেন্সি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
তবে সবথেকে বড় আঘাত আসতে যাচ্ছে হয়ত ব্রিকস এর মাধ্যমে। ব্রিকস হয়ত ভবিষ্যতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের অল্টারনেট হতে পারে। অন্তত জি-৭ দেশগুলো থেকে ব্রিকস এর সম্মিলিত জিডিপি বেশি। ব্রিকসে বাংলাদেশকে নিতে আগ্রহী চীন, ভারত রাশিয়া। এদিকে সৌদি আরব যুক্ত হতে পারে। ব্রিকস প্লাসের অধীনে এটি বিশ্বের বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে রুপ নেয়ার সুযোগ আছে।
থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনের মত আমেরিকার মিত্র দেশগুলোও নিজস্ব মুদ্রায় অথবা ডলারের বিকল্পের সন্ধান করছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোন প্রকাশ্যে ডলারের বিকল্প খুজতে আহবান জানিয়েছেন। পাপেট হিসাবে থাকতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী চীনের ক্রস-বর্ডার লেনদেনগুলোতে ৪৮.৪ শতাংশ ইউয়ান ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে ডলারের শেয়ার এক মাস আগের ৪৮.৬ শতাংশ থেকে ৪৬.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউয়ানের মাধ্যমে ক্রস-বর্ডার লেনদেন মার্চ মাসে রেকর্ড ৫৪৯.৯ বিলিয়ন ডলারের সমান।
বিশ্বের প্রায় ৫৯টি দেশের বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার চীন। আমেরিকা প্রায় ৩০টি দেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার। পশ্চিমা বিশ্বে অর্থনৈতিক গ্রোথ কমে আসছে। আইএমএফ এর রিপোর্ট বলছে ২০২৩-২৮ পর্যন্ত বৈশ্বিক গ্রোথে টপ কন্ট্রিবিউশান আসবে চীনের থেকে ২২.৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে ভারত ১২.৯ শতাংশ এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকতে আমেরিকা ১১.৩ শতাংশ। এমনকি বাংলাদেশের কন্ট্রিবিউশান ১.৬ শতাংশ থাকবে!
সম্প্রতি ইন্দোপ্যাসেফিক নিয়ে বাংলাদেশ যে অতিরিক্ত পশ্চিমা এটেনশন পাচ্ছে এরকমটি আগে ঘটেনি এভাবে।
বিশ্ব স্পটত একটি কারেন্সি যুদ্ধে লিপ্ত। মার্কিন ডলারের প্রভাব থেকে আসলেও বের হতে পারবে কিনা বা প্রভাব কমাতে পারবে কিনা সেটা হয়ত আমরা ২০২৮ বা ৩০ এর ভেতরেই আরো স্পষ্ট বুঝতে পারব। তবে যেহেতু ইউএস ইকোনমি তাদের পিক টাইম পার করে এসেছে সেক্ষেত্রে ইউএস’র পক্ষে এই যাত্রায় ডলারকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া অতটা সহজ হবেনা বলে মনে হয়। লেখক : ব্যাংকার