এক কলসি পানি আনতি হাঁটতি হয় ৩-৪ মাইল
খুলনা প্রতিনিধি : [১] আমাগের জীবনে শান্তি নেই। রাত পোহালিই কলসি কাঁখে নিয়ে বের হতি হয়। দুটো বিল পাড়ি দিয়ে সরকারি পুকুর থেইকে মিঠাপানি নে বাড়ি আসতি ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। গরমের মধ্যি তিন-চার মাইল পথ হাঁটতি দুবার জিরোন দিতি হয় পথে। সারাদিন ওই এক কলসি পানি খাতি হয় মাইপে।
[২] খাবার পানির কষ্টের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার ভাগবা গ্রামের জোবেদা খাতুন (৬০)। তার কথায় পরিবারের খাবার পানি সংগ্রহের দায়িত্ব নারীদের। পুরুষরা কেউ কৃষিকাজে, কেউ অন্য কাজে শ্রম দিতে ব্যস্ত থাকেন। পরিবারের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব তাদের।
[৩] এলাকা ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে নিরাপদ খাওয়ার পানির সংকট উপজেলাজুড়ে আরও বেড়ে গেছে। এপ্রিল মাসের শুরু থেকে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বত্রই বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার।
[৪] পরিবারের নারী ও শিশুরা প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছেন। নিরাপদ পানি দুর্লভ হওয়ায় অনেকে পুকুরের কাদা মিশ্রিত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
[৫] জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলার ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি পানযোগ্য নয়। ফলে সারা বছর ৪০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে থাকে। গ্রীষ্মের তাপদাহে সংকট আরও বাড়ে। এবার ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে ভুগছেন।
[৬] সূত্রটি জানায়, উপজেলায় গভীর ও অগভীর নলকূপের সংখ্যা ২ হাজার ২২০টি। এর মধ্যে গভীর নলকূপ ২ হাজার ১৫০ এবং অগভীর ৭০টি। গভীর নলকূপ অকেজো রয়েছে ৫০০টি। পন্ড সেন্ড ফিল্টার (পিএসএফ) রয়েছে ১২টি, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং রয়েছে ২ হাজার ৪০০টি। এ ছাড়া সরকারি পুকুর আছে ৯টি। [৭] উপজেলায় জলবায়ু ও সুপেয় পানির সংকট নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জেজেএস। সংস্থাটির সমন্বয়কারী আব্দুল মালেক বলেন, উপকূলীয় এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষকে নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদীপ্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের নিরাপদ পানির সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হয়।
[৮] তিনি আরও বলেন, সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। কিন্তু এবার প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, বাগালি, উত্তর বেদকাশিসহ উপজেলার অধিকাংশ এলাকার প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম।
[৯] পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় খাবার পানির সংকট তীব্রতর হয়েছে। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন নারীরা। এই গরমের মধ্যে তারা কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েও চাহিদামতো পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না।
[১০] সরেজমিন কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুকুরের পানি তলানিতে যাওয়ায় সেখান থেকেই ভিড় করে পানি সংগ্রহ করছেন মানুষ। কেউ ভ্যান ভাড়া করে ড্রামভর্তি করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। নদীতীরবর্তী মানুষ নৌকা ভাড়া করে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। [১১] উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের বামিয়া সরকারি পুকুরে একটি পিএসএফ রয়েছে। সেখানে পানি নিতে এসেছেন কলাপাতা গ্রামের সবিতা রানী। তিনি বলেন, রান্না ও খাওয়ার জলের অনেক কষ্ট। প্রত্যেক দিন তিন-চার মাইল রাস্তা হাঁইটে আসি জল নিতি। এর মধ্যি দুটো বিল ও একটা খাল পার হতি হয়। খাবার পানির জন্যি আমাগের যে কষ্ট তা দেখবার মতো মানুষ নেই।
[১২] মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের তেঁতুলতলারচর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার বাসিন্দারা নদীপথে নৌকা ভাড়া করে পানি নিয়ে এসেছেন। গ্রামের শরীফা খাতুন বলেন, নোনাপানির ঘেরের কারণে এলাকার পুকুরির পানিতি গা ধোয়াও যায় না। আমাগে যে পানির ট্যাঙ্কি দেওয়া হয়েছিল, তা-ও খালি হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন গ্রামের সকলে মিলে নৌকা ভাড়া করি। সেই নৌকায় ৪-৫ মাইল দূরের বানিয়াখালী এলাকা থেইকে খাবার পানি আনি।
[১৩] স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তাপদাহে এলাকার অধিকাংশ পুকুর-খালের পানি শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে, সচল নলকূপ দিয়েও ঠিকমতো পানি উঠছে না। সরকারি-বেসরকারি যেসব খাবার পানির উৎস ছিল, সেগুলো সংস্কার না করায় সংকট বেড়েছে।
[১৪] কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। এ বছর তাপদাহে পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে। পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে। বৃষ্টি না হলে এই সংকট আরও বাড়তে পারে।