আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস গাছ কি সত্যিই খারাপ?
মামুন
চিলে কান নিয়েছে শুনে নিজের কান হাত দিয়ে দেখার আগেই চিলের পেছনে ছোটার ক্ষেত্রে বাঙালীর জুড়ি নেই বলেই গল্পটা তৈরি হয়েছে।
এজন্যই কোন বিষয়ে গুজব ছড়ানোর আগে একটু পড়াশোনা করা দরকার। আবার কোন একটা বিদেশি জার্নালে পড়লাম যে এ গাছ খারাপ মানেই উপসংহার টেনে নিলাম যে গাছটা আমার দেশের ক্ষেত্রেও খারাপ হবে তাও নয়। পুরো লেখা পড়ুন, যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করুন, খামোখাই চিলের পেছনে ছুটবেন না।
কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার ঘুরতে গিয়ে দেখলাম বন্ধু বাঁধনের বাসার আসেপাশে অনেক ইউক্যালিপ্টস গাছ, নানান জাতের, কিছু গাছের নিচ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় খুব সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। অনেকেই এ গাছের তেল সংগ্রহ করে নানান রকমের ঔষধি ও প্রসাধনিতে ব্যবহার করে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে এ গাছ অনেক সমাদোরের। কিন্তু কোন দেশে সমাদোরের মানেই সবদেশেই সেটা সমাদোরের হবে বিষয়টা এমন না।
ইউক্যালিপটাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম আমেরিকার কিছু কিছু গবেষণা আসলেই গাছটাকে খারাপ দাবী করছে। কিন্তু সেই খারাপ দাবী যারা করছে তাঁরাও স্পষ্টভাবেই বলে দিচ্ছে কোথায় এবং কেন খারাপ। সবচেয়ে বড় অভিযোগটা হলো ইউক্যালিপ্টাস মাটির অনেক গভীরে গিয়ে পানি শুষে নেয়, মাটির গভীরে গিয়ে পানি শুষে নেয়ার কাজটা অনেক গাছই করে, ইউক্যালিপটাসের চাইতে বেশি করে আমাদের দেশিয় শিরিষ গাছ। এজন্য এটা জানা দরকার যে গবেষকরা এটাও বলছে যেখানে বছরে ৪০০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হয় সেখানে গাছটা খারাপ। বাংলাদেশে বছরে কত বৃষ্টি হয় গড়ে জানেন তো? ২ হাজার ১০০ থেকে ৫ হাজার ১০০ মিলিমিটার।
যাইহোক আমি উদ্ভিদবিদ না, ৮/১০টা জার্নাল পড়লেই গবেষক হওয়া যায় না। সুতরাং এবার একজন দেশি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা, দশকের পর দশক গবেষণা করা দীর্ঘ বছর ধরে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করা একজন উদ্ভিদবিদ, আরণ্যক ফাউন্ডেশন এর প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে নিচের তথ্যগুলো জেনে নেই-
এক- আমাদের জমি সীমিত। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১০০’র বেশি মানুষ বাস করেন। সেই মানুষের চাহিদা বিবেচনায় দেশি গাছের পাশাপাশি বিদেশি দ্রুত বর্ধনশীল গাছের পরীক্ষামূলক বনায়ন শুরু হয় ষাটের দশকে। বিদেশি গাছ মানেই খারাপ, এমন ধারণা অনেকের। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, দেশীয় গাছ বলে পরিচিত অনেক গাছই কিন্তু বিদেশি। ফলদ গাছের ক্ষেত্রে এটি তুলনামূলকভাবে বেশি। যদিও সময়ের পরিক্রমায় এসব গাছ আমাদের হয়ে গেছে। যেমন- কাঁঠাল, এসেছে ভারতের ওয়েস্টার্নঘাট থেকে, বাবলা এসেছে আফ্রিকা থেকে, রেন্ডিকড়ই ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে, সফেদা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, রাজকড়ই মাদাগাস্কার থেকে, সুপারি ফিলিপাইন থেকে, নারিকেল ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং তাল সেন্ট্রাল আফ্রিকা থেকে।
দুই- উপকূলীয় বনায়নে বিশ্বের কাছে এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৯৬০ সালের পরে প্রায় ২ লাখ হেক্টর উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন বনজ সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি উপকূলীয় এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংস থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছেন। রক্ষা পেয়েছে তাঁদের সম্পদ। উপকূলীয় এলাকায় বনায়নের ফলে সেখানকার মাটি চাষোপযোগী হয়েছে। ভূমির ক্ষয়-রোধ হওয়ায় ভূমির পরিমাণও বাড়ছে। উপকূলীয় বনায়ন ছাড়াও বিশ্বে আরেকটি কারণে সুপরিচিত বাংলাদেশ। তা হচ্ছে সড়ক বনায়ন। রাস্তার দু’ধারে এতো বেশি গাছ, খুব কম দেশেই দেখা যায়। বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন এই সাফল্যের দাবিদার। তবু সামাজিক বনায়ন বা সড়ক বনায়ন নিয়ে সমালোচনার কমতি নেই। সামাজিক বনায়নে সাধারণত আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হয়। দু’টি গাছেরই উৎস অস্ট্রেলিয়া। দীর্ঘদিন আগে আমাদের দেশে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় বা গল্পে শিলং পাহাড়ের কথা যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন সেই পাহাড়ি চায়ের বাগানে ইউক্যালিপ্টাস সারির কথা। এই দুই জাতের গাছ চা-বাগান হয়েই আমাদের দেশে এসেছে। প্রথমে ইউক্যালিপ্টাস, পরে আকাশমণি।
তিন-গবেষকরা সতর্ক করেন, ৪০০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় যেন ইউক্যালিপ্টাস না লাগানো হয়। এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হতে পারে। গবেষণা বলছে, ইউক্যালিপ্টাসের প্রায় ৮০০ জাত রয়েছে। কিন্তু সব জাত সব জায়গায় ভালো হয় না। ভারতে মাত্র ৫-৬ প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হয়। ইউক্যালিপ্টাস নিয়ে প্রায় সবার অভিযোগ, এটি মাটি থেকে বেশি পানি শোষণ করে। ফলে মাটি শুকিয়ে যায়। যেখানে ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হয়, সেখানে অন্য কোনো গাছ বা ফসল হয় না। বিশ্বব্যাপী এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণায় দেখা গেছে, ইউক্যালিপ্টাস মাটি থেকে যে পরিমাণ পানি গ্রহণ করে এবং তা থেকে যেটুকু কাঠ উৎপাদন হয়, অন্য প্রজাতির বৃক্ষ একই বা বেশি পরিমাণ পানি গ্রহণ করেও সেটুকু কাঠ উৎপাদন করতে পারে না। দেশীয় অনেক গাছ, যেমন সাদা কড়ই, ইউক্যালিপ্টাস-এর তুলনায় মাটি থেকে বেশি পানি শুষে নেয়, এমন প্রমাণও রয়েছে।
চাঁর- ভারত যেমন গবেষণার মাধ্যমে কোন্ জাতটি কোন্ স্থানে লাগানো উচিত তা নির্ধারণ করেছে; বাংলাদেশেও ইউক্যালিপ্টাস নিয়ে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট বিস্তারিত গবেষণা করেছে। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে ইউক্যালিপ্টাস-আকাশমণি নিয়ে যতো গবেষণা হয়েছে, দেশীয় কোনো প্রজাতি নিয়ে এতোটা হয়নি। বাংলাদেশে ইউক্যালিপ্টাস এবং আকাশমণি’র পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু হয় ষাটের দশকে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী ৪৯ প্রজাতির বীজ আমদানি করে। ১০ বছর গবেষণার পর দেখা যায়, মাত্র তিন প্রজাতির ইউক্যালিপ্টাস দেশে ভালো জন্মাচ্ছে। এই তিন প্রজাতি হলো- ঊঁপধষুঢ়ঃঁং পধসধষফঁষবহংরং, ঊ. নৎধংংরধহধ ধহফ ঊ. ঃবৎৎবঃরপড়ৎহরং. এছাড়া চা বাগানে এবং বিভিন্ন জায়গায় শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবে দেখা যায় আরও দুই প্রজাতির (ঊ. পরঃৎরড়ফড়ৎধ ধহফ ঊ. ঁৎড়ঢ়যুষধ) গাছ। প্রাথমিক বাছাইপর্বে তেমন সাফল্য না পাওয়ায় এই দু’টি জাত পরে গবেষণায় রাখা হয়নি। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথমোক্ত তিন জাতের বীজ সংগ্রহ করে নিবিড়ভাবে প্রভিন্যান্স ট্রায়াল করা হয়। এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়, কোন্ স্থানের বীজ দেশের কোন্ মাটি ও জলবায়ু উপযোগী। গবেষণায় দেখা গেছে, তিন প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে ভালো জন্মাচ্ছে পেটফোর্ড প্রভিন্যান্স। তৃতীয় পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি লাগিয়ে দেখা গেছে, সব ধরনের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলেও জাতটি ভালো হচ্ছে। এরপর দেখা হয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর কাঠ উৎপাদন ক্ষমতা, রোগ-বালাই আক্রমণের হার, পরিবেশের উপর প্রভাব, অন্য গাছের সংগে এর আচরণ, এই গাছের ফলে অন্যকিছু জন্মাতে অসুবিধা হয় কি না, ইত্যাদি। সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে ৮০০ জাত থেকে এই তিন প্রজাতির প্রভিন্যান্স অবমুক্ত করা হয়। একইভাবে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট আকাশমণি’র ৮ জাতের গাছ এনে উপযুক্ততা যাচাই করে। এতে টিকেছে দুই (অপধপরধ ধঁৎরপঁষরভড়ৎসরং ধহফ অপধপরধ সধহমরঁস) প্রজাতি।
পাঁচ- ইউক্যালিপ্টাস এবং আকাশমণি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে সরকারি অর্থে সরকারি জমিতে ইউক্যালিপ্টাস লাগানো বন্ধের আদেশ জারি হয়। এই সময় সংশ্লিষ্ট গবেষক ও উন্নয়ন-কর্মীদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বেশক’টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি আয়োজন করা হয় ১৯৯৬ সালে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট জাতীয় পর্যায়ের এক কর্মশালায় ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমণি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। এসব কর্মশালার সুপারিশ হচ্ছে, গাছ দু’টি নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়, তা পুরোপুরি সত্য নয়। আরণ্যক ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে ‘ইউক্যালিপ্টাস ডায়ালেমা’ শিরোনামের এক প্রকাশনায় এই গাছের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যসহ প্রকৃত সত্য তুলে ধরে। এতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, সব জায়গায় এসব গাছ লাগানো ঠিক নয়। মাটির আর্দ্রতা বেশি আছে এমন স্থানে এই গাছ ভালো জন্মায়। তবে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে এটি লাগানো উচিত নয়। সবচেয়ে উত্তম হলো, একক বাগানের বদলে এই গাছের মিশ্র বাগান করা।
ছয়- বাংলাদেশে আকাশমণি এবং ইউক্যালিপ্টাস বছরে হেক্টরপ্রতি গড়ে প্রায় ১০ ঘনমিটার কাঠ দেয়। পক্ষান্তরে দেশীয় গাছ হেক্টরপ্রতি গড়ে ২-২.৫ ঘনমিটার কাঠ দেয়। তাই কাঠের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এসব গাছের বেশি বেশি চাষ প্রয়োজন। তবে গাছগুলো কোথায় লাগাতে হবে, এর একটি সীমারেখা টানা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো প্রাকৃতিক বনে আকাশমণি লাগানো উচিত নয়। কারণ, এই গাছের বীজ মাটিতে পড়ে ঘন হয়ে চারা গজায়; যা বনের প্রতিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বসতবাড়িতে বা পতিত-জমিতে এই গাছ লাগানো যেতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ঝোঁপ-ঝাড় কেটে আকাশমণি বা ইউক্যালিপ্টাস লাগানো উচিত নয়। এসব ঝোঁপ-ঝাড়ে থাকা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও নষ্ট করা ঠিক নয়।