
যেকোনো প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য মালিক ও শ্রমিক দু’জনেই অপরিহার্য

মহিউদ্দিন খালেদ
শ্রমিক/মালিক ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই আপেক্ষিক মনে হয়। কে কখন শ্রমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, এটা পুরোটাই পরিস্থিতি নির্ভর। ধরেন, সিএনজি আছে প্রচুর, যাত্রী আছে কম। তখন যাত্রীরা মালিক আর সিএনজিড্রাইভাররা শ্রমিক। কারণ সিএনজিড্রাইভাররা তখন যাত্রীর কথা শুনতে বাধ্য। আবার ধরেন, যাত্রী আছে প্রচুর কিন্তু সিএনজির সংখ্যা কম। তখন সিএনজিড্রাইভাররা মালিক আর যাত্রীরা শ্রমিক। কারণ যাত্রীরা তখন সিএনজিড্রাইভারের কথা শুনতে বাধ্য। আগেকার দিনে যেসব গৃহকর্মীরা বাসাবাড়িতে থেকে গিয়ে বাসাবাড়ির কাজ করত, তারা ছিল শ্রমিক এবং গৃহকর্ত্রী ছিল মালিক, কারণ গৃহকর্মীদের গৃহকর্ত্রীদের কথা শুনতে হত। এখন বাসায় বাসায় যে ছুটা বুয়ারা কাজ করে তারা মালিক আর গৃহকর্ত্রীরা শ্রমিক, কারণ গৃহকর্ত্রীদেরই এখন ছোটাবুয়াদের কথা শুনেই চলতে হয়। আমরা যখন স্কুলে পড়েছি তখন স্যাররা ছিলেন মালিকশ্রেণি আর আমরা ছাত্রছাত্রীরা ছিলাম শ্রমিকশ্রেণি, কারণ আমাদের স্যারদের কথা শুনতে হতো। এখনকার বাণিজ্যিক কোচিংসেন্টার বা সেইম আইডিওলোজির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা মালিকশ্রেণি আর শিক্ষকশিক্ষিকারা শ্রমিকশ্রেণি। কারণ শিক্ষকশ্রেণি যদি ছাত্রছাত্রীদের কথা/চাহিদা অনুযায়ী না চলে তাহলে তাদের চাকরি থাকবে না। নতুন অভিনেতা অভিনেত্রী যখন প্রতিষ্ঠিত পরিচালকের সাথে কাজ করে তখন তারা শ্রমিক, পরিচালক মালিক।
নতুন পরিচালক যখন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা অভিনেত্রীর সাথে কাজ করে তখন পরিচালক শ্রমিক, অভিনেতা অভিনেত্রীরা মালিক। গরিবের মেয়ে যখন বড়লোক পরিবারের বৌ হয় তখন শ্বাশুড়ি মালিক, বৌ শ্রমিক। বড়লোকের মেয়ে যখন গরিব পরিবারে বৌ হয়ে আসে তখন বৌ মালিক, শ্বাশুড়ি শ্রমিক। কারখানার মালিক যখন কারখানার মুনাফা নিশ্চিত করতে পারে এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তখন কারখানার মালিক হলো কারখানার মালিক আর কারখানার শ্রমিকরা হলো কারখানার শ্রমিক। কারখানার মালিক যখন কারখানার মুনাফা নিশ্চিত করতে পারে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার ফলশ্রুতিতে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না তখন শ্রমিকরা হয়ে যায় কারখানার মালিক আর মালিক হয়ে যায় কারখানার শ্রমিক। স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে আদর্শ অবস্থান হলো স্বামী শ্রমিক এবং স্ত্রী মালিক। কারণ এর বিপরীত অবস্থানে আম এবং ছালা দুটোই যাবে। আবার যেসব মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আছে সেসব ক্ষেত্রে সমঅবস্থান একটি অবাস্তব কল্পনা। নির্ভরশীলতার সব সম্পর্কই কোনো না কোনো মাত্রার শ্রমিক মালিক সম্পর্ক। নির্ভরশীলতার সম্পর্কগুলোতে একজন অধিকাংশ সময় মালিকের অবস্থানে এবং আরেকজন অধিকাংশ সময় শ্রমিকের অবস্থানে থাকলেও খুব ক্ষুদ্র সময়ের জন্য শ্রমিকের জায়গায় অবস্থানকারী মালিকে এবং মালিকের জায়গায় অবস্থানকারী শ্রমিকে পরিণত হতে পারে।
চলার পথে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আপনাকে আগে খতিয়ে দেখতে হবে আপনি আসলে কোন অবস্থানে আছেন। আপনি যদি শ্রমিক হয়েও মালিকের অবস্থানে থাকেন তাহলে যিনি মালিক হয়েও শ্রমিক অবস্থানে আছেন তার স্বার্থ সর্বোচ্চসম্ভব রক্ষা করা আপনার মানবিক দায়িত্ব। আপনি যদি মালিক হয়ে মালিকের অবস্থানেই থাকেন তাহলে যিনি শ্রমিক অবস্থানে আছেন তার স্বার্থ সর্বোচ্চসম্ভব রক্ষা করা আপনার মানবিক দায়িত্ব। নিজের অবস্থানকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার পর আপনি যদি দেখেন আপনি মালিকের অবস্থানে, তখন শ্রমিকের অবস্থানে যে আছে তার স্বার্থ সর্বোচ্চসম্ভব রক্ষা করলে উভয়ের স্বার্থই আসলে রক্ষা হয়। যখন কোন কারখানা মুনাফা করে তখন শ্রমিকদের স্বার্থ সর্বোচ্চ সম্ভব রক্ষা করলে তাদের জীবনযাপন উন্নততর হয় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। অর্থাৎ দুপক্ষই এতে করে উপকৃত হয়। যখন কোন কারখানা মুনাফা করতে পারেনা তখন মালিকে পরিণত হওয়া শ্রমিক শ্রেণী, শ্রমিকে পরিণত হওয়া মালিক শ্রেণীর উপর তাদের সহ্যক্ষমতার চেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ না করে তাদের স্বার্থ সর্বোচ্চ রক্ষা করলে অর্থাৎ নিজেদের কম প্রাপ্তির বিনিময়ে অধিক কাজ করলে কারখানা আবার আস্তে আস্তে মুনাফার দিকে ফিরে আসতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে। কারখানা টিকে থাকা মানেই দুপক্ষের উপকৃত হওয়া নি:সন্দেহে!
এই শ্রমিক মালিক ডিল এ সবচেয়ে বড় ভুল হয় কখন? যখন আপনি নিজের অবস্থানকে সনাক্ত করতে পারেন না। আপনি নিজে শ্রমিক অবস্থানে থেকে যদি মালিকের মত আচরণ করেন তাহলে আপনার ধ্বংস অনিবার্য। আপনি মালিকের অবস্থানে থেকে যদি শ্রমিকের মত আচরণ করেন তাহলেও আপনার ধ্বংস অনিবার্য। সবচেয়ে ভয়াবহ হল নিজে শ্রমিকের অবস্থানে থেকেও নিজেকে মালিকের অবস্থানে ধরে নিয়ে, যে মালিকের অবস্থানে আছে তাকে শ্রমিকের অবস্থানে আছে ধরে নিয়ে তাকে দয়া করা! এতে করে আপনি সর্বশান্ত হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা হল প্রয়োজনে তার সাথে সমঝোতা করে আগে কৌশলে মালিকানা উদ্ধার করে নেয়া। সে পূণরায় শ্রমিকে পরিণত হবার পর তাকে দয়া করলে কেবল সেক্ষেত্রেই শ্রমিক এবং মালিক দুপক্ষই উপকৃত হয়।
যে মালিকের জায়গায় ফিট তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ নিজেকে মালিকের জায়গায় রাখার এবং শ্রমিকদের শ্রমিকের জায়গায় রাখার। যে শ্রমিকের জায়গায় ফিট তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ নিজেকে শ্রমিকের জায়গায় রাখার এবং মালিককে মালিকের জায়গায় রাখার। মালিকের জায়গায় যে থাকবে তার উচিৎ শ্রমিকদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করে চলা। এতে করে দিনের শেষে প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে এবং দুপক্ষই উপকৃত হয়। যেকোন প্রতিষ্ঠান (পরিবার/ অফিস সব) টিকে থাকার জন্য মালিক এবং শ্রমিক দুজনেই অপরিহার্য। মালিক তারই হওয়া উচিত যে মালিক হলে প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো হয়। শ্রমিক তারই হওয়া উচিত যে শ্রমিক হলে প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো হয়। যে সচরাচর মালিকের অবস্থানে থাকে অথবা সময়ের আপেক্ষিকতায় অবস্থানের পরিবর্তন হলে যে মালিক অবস্থানে থাকে, তার উচিত সর্বোচ্চভাবে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করে চলা। একটা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার এবং সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। সবাইকে মে দিবসের শুভেচ্ছা। ১ মে, দু’হাজার চব্বিশ। ফেসবুক থেকে
