
এ দেশে ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের চিন্তা কি বাস্তবায়নযোগ্য?

কাজী এম. মুর্শেদ
আমরা একটা ক্যাশলেস সোসাইটির চিন্তা করছি। এটা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। একটা সময় ছিলো যখন লেনদেনের মাধ্যম ছিলো বার্টার সিস্টেম, পণ্যের সঙ্গে পণ্যের বদল হতো। আমার জানামতে, এখন পর্যন্ত মুদ্রা ব্যবস্থার চালু বেশ আগে হলেও ধাতব মুদ্রার প্রচলন বেশি দিন হয়নি। এর আগে কোথাও কড়ি দিয়ে কোথাও মাটির টুকরায় সীল দিয়ে চলতো। আমার জানামতে এবং দেখামতে প্রথম ধাতব মুদ্রা শুরু হয় গ্রীসের কাছে ক্রিট দ্বীপে ৬০০ বিসির দিকে। আরও প্রায় ৫০০ বছর লাগে দামি ধাতু ব্যবহারে। এই ধাতব মুদ্রার চলন অনেক লম্বা সময় হলে একসময় ধাতবের অভাবে কাগজের নোট চালু হয়। আবারো বলি, আমার জানামতে কুবলাই খান ইতিহাসে কাগজের মুদ্রার প্রচলক হিসাবে থাকবেন, সেটাও ১১০০ সালের দিকে। এর পরপরই ১২০০ সালে ভেনিসে প্রথম ব্যাংক ব্যবস্থার শুরু। বিশাল সময় ধরে ধাতব মুদ্রা, কাগজের নোট আর চেকবইয়ের পর বিদেশ ভ্রমণের জন্য ট্রাভেলার্স চেক আর কুপন কার্ড আসে। একটা সময় প্লাস্টিক কার্ডও বাজারে আসে। এটা বেশি আগের কথা না। আমার নিজেরই মনে আছে ক্রেডিট কার্ড একটা বক্সে বসিয়ে উপরে একটা স্লিপ দিয়ে সোয়াইপ করলে ছাপ উঠতো। নিজে করেও দেখেছি। তারপর বিভিন্ন পিওএস মেশিনের চল শুরু হয়। বাণিজ্য তার আগে থেকেই চলছে, ব্যাংকগুলোর এলসি করা হতো একটা বই দেখে কোড দিয়ে, সেই কোড টেলেক্স করে পাঠালে অন্যরা তাদের বইর কোডের সঙ্গে মিলাতো। ব্যাপারটা বেশ ভালো ঠিলো, তবে সুইফট কোড এসে বই বন্ধ হয়ে গেছে।
এরপর আসলো পেপ্যাল, ইন্টারনেটের যুগ চলছে, মেইল আইডির সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক একত্রে এক মাধ্যম। পেপ্যালের বিশাল অবদান আছে ডিজিটাল কারেন্সির পেছনে। তারপর আসলো ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস। এখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং যে কোনো ট্রানজেকশনে ব্যবহার হলেও ছোটখাটো এমাউন্টে বিএফটিএন এর মাধ্যমে টাকা চলে যায়। অনেক দূর গেলেও চেক বা নগদ টাকা কখনোই মারা যাবে না। সেটাও চলবে। তবে গত ৩০/৩৫ বছরে যতো উদ্ভাবন হয়েছে তা অপরিসীম। আমরা যারা জেন এক্স, আমরা সবই দেখে এসেছি। নতুন কি আছে সামনে? ব্যাংকিং সহজ করতে ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা। একদিকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং সঙ্গে পেপ্যালের ইমেইল নির্ভর ব্যাংকিং সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজিটাল ব্যাংক। শুরুতে কিছু ব্যাংক হোঁচট খেলেও এখন ২০ জন লোক একটা ব্যাংক চালাতে সক্ষম। পুরোটাই টেকনোলজি নির্ভর। এরপর কি আসবে জানি না। ধারণা করতে পারি ভয়েস বা ফেইস রিকগনিশন ব্যাংকিং। ক্যাশলেস সোসাইটি হবে, তবে যা বললাম কিছু জিনিসের আবেদন থাকবেই, তেমনি নগদ টাকা থাকবে।
ট্রানজেকশন আপনি ট্যাপবেইজড কার্ড দিয়ে, কিউআর কোড দিয়ে করতে পারবেন। বিএফটিএনে বড় এমাউন্ট করবেন, কিন্তু এটিএম মেশিন তার উপযোগিতা হারাবে। খুব বেশি দূরে না, বড় কোনো ব্যাংক থাকবে না, সবই সাইজে ছোট হয়ে আসবে। কাগজের ব্যবহার আরো কমবে, সেটা এলসি হলেও। এমনকি আপনার বাসার বাইরে যাওয়ার দরকার পরবে না। বিশাল খরচ করে ব্যাংকের হেড অফিস বা ব্রান্চের দরকার কমে যাবে। বর্তমানে যা অর্থ আছে তার মধ্যে ফিজিক্যাল মুদ্রা ৮ শতাংশের মতো। সেটা আরও কমবে। টাকা ছাপানো খরচের ব্যাপার, সিকিউরড কাগজ, কালি লাগে, এ খরচ নেমে আসবে। একটা মার্কিন ডলার তৈরিতে নোটগুলোর আয়ুকাল ধরা হয় গড়ে ১৭ বছর। আমাদের টাকাও তেমনি। নোট ছোট হলে খরচ বেশি। সে তুলনায় সমস্ত ছোট নোট বিলুপ্ত হবে, বড় নোট ছাড়া কোন নোট বা কয়েনের অস্তিত্ব থাকবে না।
একটা সময় প্লাস্টিক কার্ডেরও উপযোগিতা কমে প্রি-পেইড কার্ড জায়গা নেবে, একটা কার্ডে আপনি টাকা টপআপ করে চালাতে পারবেন। একটা মুদির দোকানির আপনার নগদ টাকার প্রয়োজন থাকবে না, মোবাইলে দাম পরিশোধ হবে। আমরা ফেসবুক ব্যবহার করি, চীনে তারা উইচ্যাট ব্যবহার করে। সেটাতে তাদের অর্থ টপআপ করতে পারে, ব্যাংক থেকে সোজা উইচ্যাট একাউন্টে যায়। চীনারা বিদেশ ভ্রমণে উইচ্যাট দিয়ে লেনদেন করে, সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে ভয়েস ও ছবি সবই আছে। ক্যাশলেস সোসাইটি কি সম্ভব? আমাকে জিজ্ঞাস করলে বলবো এখনই সম্ভব। আমাদের ভিশন ২০৩০ করার কিছু নেই, বর্তমান সময়ে শুধু গ্রহণ করলেই এই বছরেই সম্ভব। পিওএস মেশিনের দাম আছে, যদি কিউআর কোড ব্যবহার করে, ক্যাশলেস সোসাইটিতে এখনই বসে আছি। এখানে বড় একটা সমস্যা আছে, যেহেতু পুরো ব্যবস্থা ইন্টারনেট ভিত্তিক, বাংলাদেশের ইন্টারনেট যেমন ধীরগতির তেমনি এর সাইবার সিকিউরিটি মানসম্পন্ন নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারে আমরা অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে, গতিতে পিছিয়ে, সাইবার সিকিউরিটিতে পিছিয়ে। এ তিনটা বাড়াতে হবে।
আমাদের ইন্টারনেটের বর্তমান চাহিদা ৫০০০ জিবিপিএস। আমরা পাই কক্সবাজার সিমিউই-৪ কেবল দিয়ে ১৬০০, কুয়াকাটা সিমিউই-৫ দিয়ে ১৬০০ এবং ভারত থেকে ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টরিয়াল কেবলে ২৭০০ মোট ৫৯০০ জিবিপিএস। তারমধ্যে আবার ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যে নাম মাত্র মূল্যে ৯০০জিবিপিএস রফতানি করতে বাধ্য হই- সরকারি চুক্তি বলে কথা। আরো যখন উপযোগিতা বাড়বে তখন গতিতে ১৩৭ তম দেশ হবার সুযোগ নাই, আমাদের আরও ব্যান্ড উইডথ দরকার। শিক্ষা দরকার যেন টাকা পাঠানো ও গ্রহণ সহজ হয়। আর দরকার অত্যন্ত দক্ষ সাইবার সিকিউরিটি টিম। এখন যা আছে তা কোনো আঙ্গিকেরই বিশ্বমান দূরের কথা, সবচাইতে নীচের কয়েকটি দেশের সঙ্গে পাল্লা দেয়। উপমহাদেশে পর্যন্ত সবচেয়ে ধীরগতি ও সিকিউরিটি ছাড়া চলছি। আমাদের সাইবার সিকিউরিটি কেন দুর্বল তার অনেক কারণ আছে, তবে সেইসব কারণ নিয়ে আলোচনা করে কাউকে বিব্রত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যা বলার ছিলো, চাইলে এ বছরই ডিজিটাল ব্যাংক শুরুর আগেই ক্যশলেস সোসাইটিতে হাটতে পারি। যারা ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে ঘরে বসে আছে, তাদের ডিমনিটরাইজেশনে ফেলে হাতে হারিকেন ধরানো কোনো ব্যাপারই নয়।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
