
ডলার সংকট ইউয়ানে আমদানি বিল পরিশোধে চীন থেকে ঋণের ভাবনা সরকারের

সোহেল রহমান : [১] চলমান ডলার সংকট মোকাবিলা এবং কাঙ্খিত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্য সে দেশিয় মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। [২] সেজন্য বাংলাদেশ প্রথমে চীন থেকে ইউয়ানে ঋণ নেবে। তারপর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে সেই ইউয়ান পরিশোধ করা হবে। [৩] বর্তমানে চীন থেকে পণ্য আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ইউয়ানে আমদানি দায় মেটানো গেলে দেশ থেকে ডলার কম বের হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ধরে রাখতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা।
[৪] বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন চলাকালে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলামের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর এক দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক চলাকালে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বাণিজ্য সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান ঋণের প্রস্তাব দিতে বাণিজ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। চীনা রাষ্ট্রদূতের এই আগ্রহ প্রকাশের পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
[৫] জানা যায়, বাণিজ্য সহায়তা (ট্রেড ফ্যাসিলিটি) হিসেবে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৩ হাজার ৬০০ কোটি ইউয়ানের বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে চায় চীন। [৬] অন্যদিকে এ ধরনের ঋণের শর্ত সাধারণত কঠিন হওয়ায় বাণিজ্য সহায়তার পরিবর্তে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কিংবা বাজেট সহায়তা হিসেবে নিতে আগ্রহী বাংলাদেশ।
[৭] সূত্র মতে, বাণিজ সহায়তা ঋণের প্রস্তাবটি নতুন ধরনের। বিষয়টি এখন অর্থ বিভাগ, ইআরডি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালণ পর্যালোচনা করে দেখছে। এ ঋণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করতে শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ঋণের অভিঘাত পর্যালোচনা করবে অর্থ বিভাগ। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মতামত পাওয়ার পর ইআরডি প্রয়োজনীয় আলোচনা ও দর-কষাকষি কার্যক্রম শুরু করবে।
[৮] অর্থ বিভাগ-এর মতে, ঋণটি বাণিজ্য সহায়তা হিসেবে গ্রহণ করা হলে তা বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত হতে পারে। এতে উচ্চ সুদ ও ঋণ পরিশোধকাল কম হতে পারে, যা বিদেশি ঋণের দায়-দেনা পরিস্থিতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে স্বল্প সুদের ঋণ নেয়া যেতে পারে। তাই বাণিজ্য সহায়তার পরিবর্তে বাজেট সহায়তা হিসেবে এই ঋণ ব্যবহার করা বেশি যুক্তিযুক্ত। পাশপাশি এ ঋণের সুদের হার কোনোভাবেই যেন ১ শতাংশের বেশি না হয় এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ যেন দীর্ঘ হয়।
[৯] অন্যদিকে গৃহীত এ ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ করা হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
[১০] সূত্র মতে, চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিলে গ্রেস পিরিয়ড বাদে পরবর্তী ১০ বছরে ঋণ ফেরত দিতে হলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হয় গড়ে ১০ কোটি ডলার। আর একই পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হয় গড়ে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
[১১] সূত্র মতে, সবদিক বিবেচনা করে ঋণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কাছে প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। আগামী জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর আগেই এই ঋণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দর-কষাকষি শেষ হতে পারে।
[১২] জানা যায়, বাংলাদেশের জন্য পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন। চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি প্রতিবছরই বাড়ছে। সেই তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে না। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। গত এক দশকে বাণিজ্যঘাটতি তিন গুণের বেশি বেড়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি, যার প্রায় পুরোটা বাংলাদেশের আমদানি। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
[১৩] অন্যদিকে দেশে চীনা ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশকে ঋণ দেয় এমন ৩২টি দেশ ও সংস্থার মধ্যে চীনের অবস্থান এখন চতুর্থ। চীনের ওপরে আছে বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ প্রতিবছর মোট যে ঋণ পায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ দেয় চীন।
