আমের সুখ, আমের দুখ!
মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন
হীমসাগর, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, সুরমাই ফজলি, নাগফজলি, আমরূপালি, মোহনভোগ, চোষা, আশ্বিনা আরও কতো কতো নামের আমে এখন ভরে ওঠে বাংলার মধুমাস! মে মাসের মাঝামাঝি থেকে মৌসুম শুরু হয়ে তা চলে প্রায় আগষ্ট পর্যন্ত। দেশের প্রায় সকল এলাকায় এখন মানুষের হাতের নাগালে থাকে এই সুস্বাদু রসাল ফল। দেশের মানুষ এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশী পরিমানের আম পাচ্ছে এবং খাচ্ছে।
আম এদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটা মৌসুমী ফল। এর স্বাদ-গন্ধ যেমন বাহারী তেমনি এর উপকারিতাও বহুমূখী। ফলে এটি খুব সহজের মানুষের পছন্দের তালিকাতে স্থান করে নেয়। কিন্তু এই আম এখন একটি পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক পণ্য! আম উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহনে এখন রীতিমতো সিন্ডিকেট। অর্থবিত্তশালী মানুষেরা এর সাথে জড়িত এবং তারাই এখন ঠিক করে কারা কোন বাগান লীজ নেবে, কারা বিপনন এবং পরিবহনে থাকবে। গত কয়েক বছরে যা আরও সর্বগ্রাসী হয়েছে। এখানে এখন কোটি কোটি টাকার খেলা।
আম গত কয়েক বছর থেকে বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। আর বিদেশে রপ্তানীর কারণে আম চাষে এসেছে নতুন মাত্রা। যারা রপ্তানীকে টার্গেট করে আম চাষ করেন তারা সেই সকল দেশের রপ্তানী উপযোগী পণ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট দেশের দেয়া শর্তগুলো মেনে চলেন। ফলে ঐসকল আমচাষীরা অনেক বেশী যত্নআত্তির সাথে আমের উৎপাদন নিশ্চিত করেন। অভিজ্ঞরা বলেন-এই সকল আম নাকি আমরা চোখেও দেখি না। তবে এতে যদি দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসে তাহলে ক্ষতি কী?
আমের কদর এবং বেশী দাম দিয়ে ভালো মানের আম ক্রয়ের মানুষ এখন ক্রমবর্ধমান। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশেও আমের বাজার প্রতিবছর বাড়ছে। এখন শহর গ্রাম নির্বিশেষে মানুষ আম ক্রয় করে এবং নিয়মিত আম খেতে কিছু পরিমান খরচ করতেও দ্বিধা করে না। ফলে বাড়তে থাকা চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে বাড়ছে আমের ফলন।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা আম উৎপাদনে আগে থেকেই বিখ্যাত। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজশাহী অঞ্চল। এই অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী সদর, নওগা আমের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া সাপাহার, পোরসা, মান্দা, তানোর, মোহনপুর ঐদিকে সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এই এলাকাগুলোও আগে থেকেই আম উৎপাদনে এগিয়ে ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং এটি লাভজনক ফল হওয়ায় এর আবাদ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। এখন রাজশাহী অঞ্চল ছেড়ে আম রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, নীলফামারী পর্যন্ত পৌছেছে। প্রতিবছর বাড়ছে নতুন নতুন আমের বাগান। যারা ভূমির মালিক তারা আম ব্যবসায়ীদের কাছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জামি লীজ দিচ্ছে। এসকল অঞ্চলের আবাদী জমি ভরে উঠছে আমের বাগানে।
কিন্তু আমের ফলনের এই যে উল্লম্ফন তা কী নিতান্তই ইতিবাচক? উত্তর হলো-না। কারণ, আমের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কৃষি জমির উপরে বিস্তর চাপ পড়ছে। যে সকল অঞ্চল আমের জন্য বিখ্যাত এবং যেখানে আমের ফলনের সম্ভাবনা আছে সে সকল অঞ্চলে কৃষিজমিতে আমের ফলন বাড়ছে। দিনে দিনে কৃষির অন্যান্য আবাদ যেমন-ধান, গম, ডাল, রসুন, আখ ইত্যাদির বন্ধ হয়ে শুরু হয়েছে আমের আবাদ। ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর কৃষিব্যবস্থায় সার্বিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। যার ফলাফল নানা বিচারে নেতিবাচক হতে বাধ্য।
আমের আবাদ শ্রমঘন নয়। এতে খুব অল্প পরিমান কৃষিশ্রমিক দরকার হয়। ফলে আমের আবাদ যতো বাড়ছে ততই কমছে কৃষি শ্রমিকের কদর। ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়ে পড়ছে। আর এর অনিবার্য অভিঘাত এসে পড়ছে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনে এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক হচ্ছে। কারণ সমতলের এই সকল আদিবাসীরা মূলত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা হাজার বছর ধরে কৃষিভিত্তিক কাজে নিজেদের দক্ষতা দেখিয়ে এসেছে। তারা কৃষি ছাড়া আর তেমন কাজ জানে না। ফলে আমের আবাদ বৃদ্ধির কারণে এই কৃষিভিত্তিক আদিবাসী সমাজের জীবিকায়ন সার্বিকভাবে হুমকীর মধ্যে পড়েছে।
আমের আবাদ বৃদ্ধির কারণে আদিবাসীদের কাজের কদর কমে যাওয়া, কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়া’র অনেকগুলো নেতিবাচক ফলাফল ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। আদিবাসীদের মধ্যে যারা শ্রমিক কাজ করে বিশেষ করে পুরুষেরা তারা কাজের সন্ধানে দূর-দূরান্তে ছুটছে। তারা এখন বছরের একটা বড় সময় বাড়ির বাইতে স্ত্রী-সন্তানদের রেখে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে একদিকে তারা হারাচ্ছে তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের দক্ষতা এবং অন্যদিকে তারা পাচ্ছে না পরিবারের সঙ্গ। ফলে কাজ হারানোর পাশাপাশি তাদের পারিবারিক জীবনেও বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
বাড়ির পুরুষরা দীর্ঘদিন বাইরে থাকার কারণে আদিবাসী নারীদের জীবনে উপস্থিত হয়েছে নতুন বাস্তবতা। তাদের জীবন এখন নিরাপত্তাহীন। কারণ বাড়ির পুরুষ সঙ্গীদের ছাড়া আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের বিপদাপন্নতা বাড়ে। ফলে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাড়ছে বাল্যবিবাহের হারও। যা কোনোওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ফলে আমের বাজার বৃদ্ধি এবং তার ফলে আবাদে যে উল্লম্ফন তা অনেকের জন্য সুখের কারন হলেও আদিবাসীদের জন্য বয়ে এনেছে দুঃখজনক বাস্তবতা। এর পরিবর্তন আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। কারণ পরিস্থিতি যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতির পরিমান বাড়বে বৈ কমবে না। যেমন-দেশে চাহিদার তুলনায় আমের ফলন বেশী হলে এবং তা যথাযথভাবে বিদেশে রপ্তানী করতে না পারলে এর চাহিদা নিম্নগামী হতে বাধ্য। এবারই কিন্তু আমের ফলন বেশী হওয়ার কারণে চাষীরা দাম তেমন পায়নি। মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বলে- যে পরিমান বাগান ইতিমধ্যে করা হয়েছে তাতে আগামী বছরগুলোতে এর ফলন কেবল বাড়বেই।
তাছাড়া, আবাদী জমিতে আমের বাগান করার কারণে ধান এবং রবিশস্যের উৎপাদন ইতিমধ্যে অনেক কমে এসেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আজকে না হোক নিকট ভবিষ্যতে পড়তে বাধ্য। কৃষি শ্রমিক হিসেবে বেকার হয়ে পড়া আদিবাসী মানুষের দেশান্তরী হওয়ারও যে নান রকম সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব সেটাও বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। আমরা আশা করবো সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করুক। লেখক : প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, হেকস/ইপার