নপুংসক, ক্রনি ক্যাপিটাল ও দিনশেষে খেলাপি ঋণের বোঝা
নাসির উদ্দিন
আমি নপুংসক। না হয় এতো অচৈতন্য হব কেন? কেবল নারীর বেলায়ই যে, তা নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নপুংসক। কোনো কিছুতেই আমার শির দন্ড কিছুই সোজা হয় না। আমার পঙ্গুত্বের প্রমাণ, আমার অক্ষম আত্মসমর্পণ। তাই আমার টাকায় দৈত্য বনে, ওরা আমাকেই উলঙ্গ করে সার্কাসের মজা নেয়। এমন নপুংসকের চাষ পৃথিবীর আর কোথাও নেই, আছে এই বঙ্গে। এজন্য পৃথিবীর একমাত্র এই দেশেই দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির সাম্বা নৃত্য উদযাপিত হচ্ছে। কথাগুলো বললাম একটি এলোমেলো চিন্তা থেকে। আমার মতো মূর্খ মাথায় দেশ লুটের চিন্তা কাজ করলে ফেসবুক ফাটিয়ে ফেলা বিজ্ঞরা চুপ কেন? যেন সবাই শান্তির নহরে প্লাবিত হচ্ছে। ভূরিভোজের ছবি, আড্ডার ছবি, অযোগ্য টাকাওয়ালা সমাজে গ্যাংগ্রিন ছড়ানো নেতার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি, বাসে ট্রেনে বা কোথাও বেড়াতে গিয়ে আহ্লাদী ছবি বা অন্য কোনো চটুল কিছু দিয়ে ফেসবুক ভাসিয়ে ফেলছে কিভাবে? ফেসবুকে চারপাশে কেবল সুখের ছবি।
সবাই ভীষণ সুখী। এ হয়তো আমারই অজ্ঞতা। এজন্যই নিজেকে নপূংশক মনে হয়। নপুংসকের চিন্তাটা একটু খুলেই বলি, বাংলাদেশ ব্যাংক গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দেখিয়েছে, ১.৫৬ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাব অবশ্যই মামলায় থাকা ২ লাখ কোটি এবং অবলোপনকৃত ৫৫ হাজার কোটির বাইরে। মানে খেলাপী ঋণ ৪.১১ লাখ কোটি। আমাদের গত জাতীয় বাজেট ছিল ৭.৬১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের খেলাপী ঋণ, গত জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশী। ৫৪ শতাংশ আর গত বাজেটে ঘাটতি ছিল ২.৬১ লাখ কোটি টাকা। তার মানে যদি খেলাপী ঋণ না থাকতো তাহলে বাজেটে ১.৫০ লাখ কোটি উদ্বৃত্ত থাকতো। উদ্বৃত্ত থাকলে দ্রব্যমূল্য, রিজার্ভ সবই আমার পক্ষে থাকতো। খেলাপী ঋণের কারণে বাজেটেই আমি কুপোকাত। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলো দেশে মোট ঋণ বিতরণ করেছে, ১৫.৪৩ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৪.১১ লাখ কোটিই খেলাপী। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত ঋণের ২৭ শতাংশ খেলাপি।
৭৩ শতাংশের ওপর একশো শতাংশের বোঝার দায় পড়েছে। ফলে সে প্রায় পঙ্গু। এজন্যই আমাদের অর্থনীতি এখন প্রায় দেউলিয়া দশায়। কিন্তু সরকার, আইএমএফ এবং দাতা সংস্থার কাছে লুকানোর জন্য ঋণের মিথ্যা তথ্য দেখায়। দাতা সংস্থার চাপে, খেলাপীদের ওপর এক কিস্তির অর্ধেক চেয়েছিল সরকার। তাহলেই তারা খেলাপী থাকবেনা। খেলাপী কম দেখানোর চৌর্যবৃত্তি। ভিক্ষার মতো চেয়েও কাজ হয়নি। এমনকি তাদের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনও করেছে, তাতেও কিচ্ছু হয়নি। বরং খেলাপী ঋণ বাড়ছেই।
কারণ এতো কিছু অমান্যের পরও মহান সংসদেই খেলাপীদের পুনরায় ঋণ দেয়ার সুযোগ করে দেয়ার আইন হয়েছে। অবশ্য এই দুর্বৃত্তদের সুযোগ আমি নপুংসকই করে দেই। কারণ টাকাওয়ালা নেতাইতো আমার পছন্দ। খেলাপি ঋণ মানে, ব্যাংক ওই ঋণ থেকে সুদ পায় না। এতে ব্যাংকের মুনাফা কমে। ব্যাংকে টাকার পরিমাণ কমে, সৃষ্টি হয় ব্যাংকে টাকার সংকট। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা এবং নতুন বিনিয়োগ কমে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে। এতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ও রিজার্ভসহ সব ধরনের আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাংকের মুনাফা কমে গেলে সরকারের কর কমে। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের দাম কমে। অপরদিকে, খেলাপী ঋণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব হচ্ছে, উৎপাদনের উদ্দেশ্যে দেয়া ঋণ বিনিয়োগ না হলে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হয়। ঋণ খেলাপি বাড়লে, বাজেট ঘাটতি বাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে বেশি টাকা ছাপায়।
তখন মুদ্রাস্ফীতিও বাড়ে। ঋণের টাকা উৎপাদনে ব্যবহার হলে টাকার বিপরীতে বাজারে পণ্য থাকতো। মুদ্রাস্ফীতি হতো না। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের মুনাফা কম দিচ্ছে। কৃষক ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে না। পেলেও সুদ বেশী দিতে হচ্ছে। এই বাড়তি সুদের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে।
টাকার সংকটে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিসারী সহ সকল নিত্য পণ্যের ক্ষেত্রে। বেসরকারি এসব খাতে বিনিয়োগ না থাকায় এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে পণ্য মূল্যের ওপর। কমে টাকার মান। বাড়ে ডলারের। পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। এসব কারণে আমাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। দিনশেষে এই খেলাপী ঋণের বোঝার সকল দায় পড়ছে আমার ওপর।
সরকার এই ক্রিমিনালদের কাছ থেকে প্রাপ্য কর না পেয়ে সেই করের বোঝা চাপায় আমার ওপর। প্রত্যক্ষ করের পাশাপাশি পরোক্ষ করেও আমি জর্জরিত হই। আসলে আমি এমনই নপুংসক যে, এই অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাঁচার কোনো চেষ্টাই করি না। ১৫-৫-২৪। ফেসবুক থেকে