![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)
হুন্ডি কীভাবে কাজ করে, কী কারণে হুন্ডিতে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী প্রবাসীরা?
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/uploads/2024/04/Quazi-M-Murshed1-359x400.jpg)
কাজী এম. মুর্শেদ
হুন্ডি কীভাবে কাজ করে? হুন্ডিতে সমস্যা কী হয়, আর সুবিধা কী সেটা বোঝা দরকার। একইসঙ্গে ব্যাংকের সঙ্গে কোথায় সমস্যা বলি। হুন্ডি হলো বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবার রাস্তা। হুন্ডি যেহেতু অফিশিয়াল রাস্তা নয়, তাই এটাকে দুই নম্বরি ব্যবসা বললাম। দুই নম্বরিতে সাধারণত দুই নম্বরি হয় না। এখানে বিশ্বস্ততা একটা বড় ফ্যাক্টর। তবে আমার শোনা এক দুই নম্বরিতে দুই নম্বরি হয়েছিলো, সে সচিব মহোদয় টাকা আগেই খেয়ে নিয়েছিলেন, পরে অন্যত্র বদলির পর পুরো অস্বীকার করে বসেন। আমলারা কীভাবে জানি সবকিছুতেই দুই নম্বরি রাস্তা তৈরি করে ফেলেন। হুন্ডি এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে বলছিলাম। মনে করুন এক ভদ্রলোক আমেরিকা থেকে দেশে টাকা পাঠাবেন। তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে ১১০ টাকা হারে তার পরিবার পাবে। ৫ হাজার ডলার পাঠালে এটা হবে ৫ লাখ ৫০ হাজার, সঙ্গে ব্যাংকে কাগজপত্র সব ফর্মালিটি শেষ করে ৫/৭ দিন পরে টাকার মুখ দেখবে। তিনি যদি হুন্ডিতে টাকা পাঠান, তার আমেরিকার এজেন্টকে হাতে নগদ ৫,০০০ ডলার দেবে, তিনি এজেন্টের বিশ্বস্ত বাংলাদেশি এজেন্টকে একটা মেসেজ দিয়ে বলবেÑ এ ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে টাকা দিয়ে দিতে। দেশের এজেন্ট কোনো সময় নষ্ট না করে হয় টাকা হাতে পৌঁছে দেবে বা ব্যাংকে জমা দেবে বা বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবে। সময় কয়েক মিনিট থেকে ঘণ্টা। এখানে পরিবার পাবে ১২০ টাকা করে ৬,০০,০০০ টাকা। আর যিনি পাঠালেন তিনি ৩ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আমেরিকায় রাখলে (যদি রাখে) তা হবে ১৬,৫০০ টাকা। এখন বলুন, মানুষ হুন্ডি কেন করবে না যখন দেখে টাকা কষ্টের পয়সা পাঠানোতে তার লাভ হচ্ছে।
পরিবার হাতে ৩৩,৫০০ টাকা বেশি পায় এবং টাকা সঙ্গে সঙ্গে হাতে পায়। এ হুন্ডি রেট যদি ১২৫ টাকা ডলারে হয়, তারপরও ৫৮,৫০০ টাকা বেশি পায় যদি ৩ শতাংশ সার্ভিস চার্জ নেয় এবং সাতদিন সময় বাচে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, ডলার কিন্তু কোনো ব্যাংকে যায়নি। ঢাকা থেকে অনেকে বিদেশে টাকা পাঠায়, তার রাস্তা দুইটা, হয় বিদেশ ভ্রমণের সময় ১০০ ডলার নোট সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বা হুন্ডি করা। যদি যাতায়ত খরচ উঠে যায়, অনেকে নিজেই চলে যায়। ধরুন পাঁচ কোটি টাকা পাঠাবে। তিনি বেরিয়ে আসলো। আবার ৪৫৪৫টা ১০০ ডলারের বান্ডিল সঙ্গে নিলেন। বাংলাদেশে অনেক ছোট মনের বড়লোক মানুষ আছেন যারা ১ কোটি টাকা খরচ করে চার্টার প্লেন নিয়ে যেতে পারেন। আবার অনেকে বিভিন্ন কূটনীতি পাসপোর্ট বা সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণে এভাবেই যায়। তাদের কোনো চেকিং হয় না। সম্ভবত ২০১৪ সালে এমন এক ঘটনায় ঢাকা এয়ারপোর্ট কাস্টমস এক নেতার স্ত্রীকে নগদ ডলারসহ আটকায়। উপহার সরূপ তিনজনকে এয়ারপোর্ট থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে বের করে দেয় যেন ফ্লাইট ধরতে পারে। অন্য রাস্তা হলো হুন্ডি। আপনি স্থানীয় এজেন্টকে টাকা বুঝিয়ে দিলেন, তিনি তার আমেরিকার এজেন্টকে জানাবে কাস্টমারের সন্তানের টিউশন ফি জমা করে দিতে। এক্ষেত্রে লোকাল এজেন্ট সার্ভিস চার্জ বা কমিশন রাখবে। হুন্ডিতে দুই দফা কমিশন নেয় না, কারণ চলমান ব্যবসা, একজন রাখলেই হয়, টাকা আর ডলার দুই মুখী পরিবহন হয়। আমার লেখা পড়ে হুন্ডি ব্যবসায় নামতে যাবেন না। এ ব্যবসা যথেষ্ট কঠিন এবং অনেক কাগজপত্র তৈরি করতে হয়। একইসঙ্গে বিভিন্ন মুখ হা করে আছে, তাদের কমিশন থেকে ভাগ দিতে হয়।
হুন্ডির ক্লাস শেষ। এবার অফিশিয়াল রাস্তায় টাকা পাচারের পথ বলি। মনে করুন আপনি বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনবেন। আপনার সে কাঁচামালের দর ১ মিলিয়ন ডলার। এ টাকা আপনাকে দিতে হবে। প্রথম কাজ আপনার পরিচিত লোক বা আত্মীয় সে দেশে গেলো। যা ডলার দেওয়ার সেটা একটা লোকাল এলসি করলো। যে বিক্রেতা সে টাকা পেলেই হয়, সোর্স দরকার নেই। এবার ঢাকা থেকে সে দেশে সে ভাইয়ের কোম্পানিতে ২ মিলিয়ন ডলারের এলসি করলো, এটাই ওভার ইনভয়েসিং। মাল আসলে এখান থেকে ২ মিলিয়ন ডলার চলে গেলো, সে দেশে ১ মিলিয়ন ডলার তার নিজস্ব একাউন্টে গেলো আর বাকীটা এলসি দিতে। টাকা বাইরে পাঠানোর এ রাস্তা এতোবার ব্যবহার হয়েছে, আপনাদের না বোঝার কিছু নেই। সরকারের লাভ হলো, ২ মিলিয়ন ডলার ভ্যালুর উপর যা আমদানি শুল্ক পায়। আবার মনে করেন অনেক সময় আন্ডার ইনভেয়েস করেও আমদানি হয়। যেমন ধরুন কেনা দাম ১ মিলিয়ন ডলার, এলসি করলো ৫ লাখ ডলারের। বাকি দেড় মিলিয়ন ডলার হুন্ডিতে চলে গেলো। এ আমদানিতে হুন্ডির কারণ যেসব পণ্যে কাস্টম ডিউটি, ভ্যাট, সারচার্জ ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বেশি, তখন ভ্যালু কম দেখাতে হয়। না হলে সরকার নিজেই ৬২ শতাংশ এর মতো কেটে রাখে। এবার রপ্তানিতে আসেন। আপনি আন্ডার ইনভয়েসিং করবেন সেটা মোটামুটি সবার জানা, কেউ মুখ খুলবে না। ধরেন আমেরিকায় পণ্য পাঠাবেন, আপনার ভাই সেখানে বসে মূল ডিলিং করবে। অর্ডার দেশে আসছে ২ মিলিয়ন ডলারের, আপনি এলসি করলেন ভাইয়ের নামে ১ মিলিয়ন ডলার দেখিয়ে। মাল পৌঁছে গেলে মূল ক্রেতা আপনার ভাইকে ২ মিলিয়ন ডলার দিলো। আপনার ভাই ব্যাংক থেকে এলসি বাবদ ১ মিলিয়ন দেশে পাঠালো যেটা এলসি ভ্যালু। বাকী টাকা সেখানেই থেকে গেলো। অফিশিয়াল বলেন, আনঅফিশিয়াল, হাইব্রিড বলেন, ক্ষমতার জোরে বলেন, রাস্তা আছেই। অনেক রাস্তা আছে।
বাঙালি রাস্তা না থাকলে বের করে ছাড়ে। যেমন ধরুন টিকেট ছাড়া বিমান ভ্রমণ বলেন বা প্লেন ঝুলে হলেও রাস্তা বার করবে, তেমনি নৌকা নিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়াও তেমন ডেসপারেট মিশন। আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েস ক্লাস শেষ। এবার আসেন এর ইমপ্যাক্ট নিয়ে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ডলার সঞ্চয় আছে। যখন বৈদেশিক রিজার্ভ হিসাব করা হয়, তখন ব্যাংকগুলোর এ হিসাব যোগ করা হয়। আগে হয়তো বলেছি, হুন্ডিতে ডলার কোনো হিসাবে আসে না, তবে এলসির হিসাব আসবে। তেমনি রেমিটেন্স যদি ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠায় সে হিসাব আসবে। এখানে একটা ব্যাপার সুক্ষ্ম, তাহলো রেমিটেন্স হোক বা এলসি সেটেলমেন্ট, কোনো ফিজিকাল ডলার আসা যাওয়া করে না। এটা সব খাতায় হিসাবে থাকে। এ মাঝের ব্যাংকটাকে বলে করেসপন্ডেন্ট ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সাধারণত ব্যাংক অফ আমেরিকার নিউ জার্সি ব্রাঞ্চে ডলারের স্থিতি রাখে। এখানে দুইটা টার্ম মনে রাখেন একটা হলো নস্ট্রো একাউন্ট বা আমার একাউন্ট অন্যটা ভস্ট্রো একাউন্ট বা তোমার একাউন্ট।
হিসাব কীভাবে হয় বলি। ধরেন আমদানির জন্য এলসি করলেন ঢাকা থেকে কোনো ব্যাংক মারফত। আমেরিকার ব্যাংক ধরলাম সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (যেটা কয়দিন আগে বন্ধ হয়েছে) এলসি পাবার পর দেশি ব্যাংক ট্রান্সমিট করবে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে, তারা করেসপন্ডিং ব্যাংকে যোগাযোগ করবে। ব্যাংক অফ আমেরিকা দেখবে বাংলাদেশি ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্টে কি ডলার আছে। যদি সন্তুষ্ট হয়, তারা জানিয়ে দেবে। মাল পাঠানোর পর এলসির কাগজ জমা করলে সিলিকন ভ্যালি টাকা চাইবে করেসপন্ডিং ব্যাংকের কাছে, তারা বাংলাদেশি ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্ট থেকে ডলার কেটে নিয়ে প্রথমে ভস্ট্রো একাউন্টে দেবে, সেখান থেকে সিলিকন ভ্যালিকে তাদের নস্ট্রো একাউন্টে দিয়ে দেবে। মাঝের কমিশনের হিসাবে গেলাম না, এমনকি কনফার্মেশন ব্যাংকেও গেলাম না।
এবার ঠিক উল্টো হিসাব করেন, সেটা হয় রপ্তানির ক্ষেত্রে, ডলার বাংলাদেশি ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্টে জমা হয়, তারা জানিয়ে দিলেই হয়, কোনো ডলার নড়া চড়া নেই। যে কারণে বললাম, আপনি যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠান, বাংলাদেশি ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্ট বাড়বে। এটা বাড়া মানেই দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ বেড়ে যাওয়া এবং একইসঙ্গে সে ব্যাংকের এলসি করার ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া। কোন ব্যাংকের কী অবস্থা সেসব আলোচনার দরকার নেই, বিশেষ করে কিছু ব্যাংক হরিলুট হওয়ার পর এবং অধুনা একীভূতকরণের পর কিছু সময় লাগবে ঠিক হতে। হুন্ডির কথা এজন্য বললাম কারণ হুন্ডি করলে আমেরিকায় এক ব্যক্তির হাতে ডলার যাচ্ছে এবং সে ব্যক্তি ব্যাংকে জমা দিচ্ছে। এ টাকা কোনো বাংলাদেশি ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্টে না দেখানোর জন্য সরকারি হিসাবে বৈদেশিক রিজার্ভে দেখায় না, কোনো ব্যাংকের এলসি করার ক্ষমতা বাড়ে না।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)