কৃষি খুব একটা লাভজনক কাজ নয়, কিন্তু বেশির ভাগ উন্নত দেশ কৃষকদের জন্য নানাপ্রকার ভর্তুকি বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করে
ইমতিয়াজ মাহমুদ
কে যেন বাক্যটা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এখন গৃহস্তের বাড়িতে জামাই বেড়াতে এলে জামাই আপ্যায়ন করার জন্য কমবেশি এক ট্রাক ধান বিক্রি করতে হয়। কথাটা শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। বন্ধুকে বলেছিলাম, দুর ভাই, আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারের বদনাম করার জন্যে এসব উদ্ভট কথা বলছেন। বন্ধুর তাড়া ছিল, যেতে যেতে তিনি কেবল হেসে বলে গেলেন, আপনি হিসাব করে দেখবেন। আমি কিনা গণিতে কাঁচা, তেত্রিশ পেয়ে গণিত পাশ করা ছাত্র, হিসাবে ভয় পাই। আমি হিসাবটা আর করিনি। আপনি কি একটু করে দেখবেন? একটা দৃশ্যপট দিচ্ছি আপনাকে।
মনে করেন কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনা বা সুনামগঞ্জের গ্রামে একজন সম্পন্ন গৃহস্তের ঘরে মেয়ে বেড়াতে এসেছে বাচ্চাদের নিয়ে। জ্যৈষ্ঠ মাসে আম-কাঁঠালের সময়, বাচ্চারা নানার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। দিন সাতেক মেয়ে আর নাতী নাতনী থাকবে আর সপ্তাহান্তে জামাই আসবে মেয়ে আর বাচ্চাদের নিয়ে যেতে। জামাইয়ের সাথে ধরেন জামাইয়ে একজন বোনও আসবে বেড়াতে। এই যে সপ্তাহটা, নাতী-নাতনী মেয়ে মেয়েজামাই আর ঝিয়ারিকে আপ্যায়ন করতে হবে না? এই সাত দিনে ওদের কয়েকবেলা পোলাও খাওয়াতে হবে, সাথে একটু মুরগির মাংস বা গরুর মাংস, সাথে ভালো একটা মাছের আইটেম, একটা সবজি, একটু ডাল। খাওয়ার শেষ পাতে একটু দই সাথে নিজের এলাকার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। কয়বেলা পোলাও খাওয়াবেন আর কয়বেলা সাদা ভাত সেটা আপনিই ঠিক করে নিন। সাথে বিকালে একটু চা নাস্তা আর সকালে একটু ভালো নাস্তা, মাঝে মাঝে কয়েক টুকরো আম, দুই তিনটা কাঁঠাল, ভালো করে ঝাঁকিয়ে একটু জাম বা আপনার পছন্দমতো অন্য কোন দেশি ফল। ঘরের মানুষ ধরেন তিনজন বা চারজন, নাতী-নাতী আর মেয়ে মিলে তিনজন, জামাই আর ঝিয়ারি এই দুইজন। লিখে নিন।
এবার হিসাব করেন এই সাতদিন ভালোমন্দ এইভাবে খাওয়ার জন্যে কতো খরচ হবে? বাজারের জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে তো আপনার একটা ধারণা আছেই। জামাই বাড়িতে এলে তাকে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, সেইটা হিসাব করবেন কী করবেন না সেটা আপনার ইচ্ছা। এই যে হিসাবটা করলেন, সেই হিসাবের মোট টাকার অংকটা নিন, আর সেই অংকটাকে সাড়ে সাতশ টাকা দিয়ে ভাগ করুন। সাড়ে সাতশ টাকা হচ্ছে একমন ধানের দাম। একমন মানে কিন্তু চল্লিশ সের না, একচল্লিশ কেজি। একচল্লিশ কেন? কারণ ধানের বাজারে ওরা চল্লিশ কেজিতে একমন ধরে আর প্রতি মনে এক কেজি করে বাড়তি আলগা দিতে হয়। আপনার হিসাবে যে কয়েকমন ধান আসে, সেটা পরিবহন করতে মোটামুটি টাটার একটা ছোট ট্র্যাক নিশ্চিত ভাড়া করতে হবে। হিসাবটা করুন, সিরিয়াসলিই করুন। হাসি তামাশার বিষয় না।
একটা কথা মনে রাখবেন, এই ফসল বিক্রি করেই কিন্তু চাষিকে বীজের দাম, মজুরি, সারের দাম, কীটনাশকের দাম এই সবকিছু শোধ করতে হয়। হিসাবটা একটু করেন, চাষির অবস্থা যে কি তার একটা আংশিক চিত্র পাবেন। এরপর আপনি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন, এই যদি হয় অবস্থা, তাইলে গৃহস্তরা কৃষিকাজ কেন করবে? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই সমস্যা। কৃষিকাজ খুব একটা লাভজনক কাজ না। কিন্তু বেশির ভাগ উন্নত দেশই কৃষকদের জন্যে নানাপ্রকার ভর্তুকি বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করে। এর ফলে চাষবাস করা কৃষকদের জন্যে মোটামুটি লাভজনক হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, সেই মেয়াদে সরকারের সাথে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ ওদের তর্কাতর্কি হয়েছে অনেক। ওইসব সংস্থার সুপারিশ ছিল যে কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। তখন আমাদের যিনি কৃষিমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এসব সংস্থার ব্যবস্থাপত্র আমরা মানবো না। এর ফল সেই কয়েক বছর আমরা পেয়েছিলাম। আপনারা মেহেরবানী করে ওই অংকটা করতে ভুলবেন না। বিশেষ করে তরুণ বন্ধুরা, এখনকার ছেলেমেয়েরা গণিতে নাকি খুব পাকা হয়। করেন একটা অংক। লেখক: আইনজীবী। ১৭-৫-২৪। ফেসবুক থেকে