
স্কুলে যাওয়া বন্ধ সেই ১৬৯ ছাত্রীর আদালতের দিকে তাকিয়ে অভিভাবকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক : [১] রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল রাবেয়া তাসনিম। ভালো স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করাতে পেরে উচ্ছ্বসিত ছিলেন বাবা-মা। পড়ালেখায় আগ্রহ বেড়েছিল ছোট্ট রাবেয়ারও। দেড়মাস স্কুল যাওয়ার পরই তার ভর্তি বাতিল হয়। মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় বাবা-মায়ের উচ্ছ্বাস, থামকে যায় রাবেয়ার পড়ালেখাও।
[২] সেখান থেকে আড়াইমাস ধরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ, দিন-রাত কাটছে বাসায়। বাবা-মা যেটুকু পড়ান, তাতে সন্তুষ্ট নয় মেধাবী শিশুটি। সারাক্ষণ বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে—আবার কবে সে স্কুলে যেতে পারবে
[৩] ছোট্ট রাবেয়ার এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই তার বাবা-মায়ের কাছে। জানে না স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরও (মাউশি)। রাবেয়া কবে তার পছন্দের স্কুল ভিকারুননিসায় যেতে পারবে কিংবা পারবে না, তা এখন ঝুলে আছে উচ্চ আদালতে। শিক্ষাবর্ষের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে মেলেনি সুরাহা। ফলে মেয়ের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কায় বাবা আসলাম উদ্দিন ও মা সালেহা পারভীন। [৪] আসলাম উদ্দিন বলেন, বিনা দোষে মাউশি-ভিকারুননিসা আমার মেয়েটার ভর্তি বাতিল করেছে। আমরা রিট করেছি। আদালত এখনো নিষ্পত্তি করে রায় দেননি। কবে রায় হবে, জানিও না। বছরের পাঁচ মাস তো শেষ। ক্লাস হবে হয়তো আর পাঁচ মাস। স্কুলে যাওয়া ছাড়াই কি ওর এ বছর পার করতে হবে [৫] শুধু রাবেয়া নয়, তার মতো আরও ১৬৮ শিশু শিক্ষার্থীর ভর্তি মাউশির নির্দেশে বাতিল করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। মোট ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর বাবা-মা এখন সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত। পাশাপাশি স্কুলে যেতে না পেরে ঘরবন্দি হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে শিশু শিক্ষার্থীরাও। [৬] মাউশি ও ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ বলছে, আদালতের নির্দেশনার আলোকে ১৬৯ জনের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। সেখান থেকে যে রায় হবে, সেটাই তারা বাস্তবায়ন করবেন। তার আগে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসার সুযোগ দিতে অপরাগ তারা।
[৭] আমরা গভর্নিং বডিতে আলোচনা করে এবং মাউশিকে অবগত করেই ১৬৯ শিশুকে ভর্তি করেছিলাম। পরে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। সেজন্য এটা নিয়ে বেশি কথা বলা উচিত হবে না।- ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী [৮] আইনি এ লড়াই দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করেন দুই পক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলছেন, নিজেদের পক্ষে রায় নিতে দুই পক্ষই শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে চান। এতে সহসাই আদালত থেকে সুরাহা মিলবে কি না, তা নিয়ে আইনজীবীরা কিছু জানাতে পারেননি।
[৯] মাউশির নির্দেশনার পর গত ৫ মার্চ ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের কথা জানায় ভিকারুননিসা। এরপর থেকে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ ভর্তি বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের। ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা তাদের কোথাও ভর্তিও করাননি। তাদের বাবা-মা ভিকারুননিসা স্কুলেই সন্তানকে পড়াতে চান। ফলে কোনো কিন্ডারগার্টেনে পাঠাতে রাজি নন তারা।
[১০] অভিভাবকদের দাবি—তারা কোনো ভুল করেননি। তদবির বাণিজ্য করেও সন্তানকে ভর্তি করেননি। এজন্য সন্তানদের বাসায় রেখে পড়াচ্ছেন তারা। তাদের প্রত্যাশা—আদালতের রায়ে তাদের সন্তান ফের ভিকারুননিসায় পড়ার সুযোগ পাবে।
[১১] রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুননিসার মূল শাখায় মেয়েকে ভর্তি করেছিলেন কাওসার আহমেদ। মেয়ের ভর্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। কাওসার আহমেদ বলেন,দোষটা আমাদের নয়। আমরা নিয়ম মেনে আবেদন করেছিলাম। লটারিতে নির্বাচিত হয়ে সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি করেয়েছি। ভুল করলে মাউশি করেছে, ভিকারুননিসা করেছে। আমার মেয়ে ভিকারুননিসায় না হলে অন্য ভালো স্কুল পেতো। এখন তাকে কেন আমি গলির স্কুলে ভর্তি করবো এজন্য আইনিভাবে লড়ছি আমরা।
[১২] ভিকারুননিসার আজিমপুর শাখার অভিভাবক সৌমেন দে বলেন, মেয়েটার স্কুলে যাওয়ার আকুতি আর সহ্য করতে পারি না। প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরলে ওর স্কুল নিয়ে গল্প শুরু হয়ে যায়। অথচ প্রায় তিন মাস হলো মেয়েটা স্কুলে যেতে পারছে না। এটা খুব কষ্টকর।
[১৩] রিয়াজুল ইসলাম নামে আরেকজন অভিভাবক বলেন,ভর্তি বাতিলের পরও আমি মেয়েকে কিছুদিন স্কুলে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের সামনের দিকে বসতে দেয় না, রোল কল করে না, ডায়েরি দেয় না। এতে মেয়েটা আরও ভেঙে পড়ছিল। পরে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি।
[১৪] এভাবে স্কুল হারানো শিশুরা ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে পারে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ৬-৭ বছরের শহুরে একটা শিশু স্কুলে গেলো, বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হলো, তারপর হুট করে স্কুলছাড়া হলো। এটা তো অবশ্যই একজন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্কুলে যেতে না পেরে বাসায় বসিয়ে রাখাটাও খুবই ভয়ানক ব্যাপার। হয়তো তাকে অন্য স্কুলে দিলে কিছুটা হলেও মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারতো।
[১৫] বয়সের ঊর্ধ্বসীমা না মেনে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভর্তি করানোয় বিপত্তিতে পড়ে ভিকারুননিসা। মাউশির ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী—২০১৮ সালে জন্ম নেওয়া কয়েকজন শিশু ভর্তিযোগ্য ছিল। ভিকারুননিসা মাউশির নীতিমালা লঙ্ঘন করে বয়সসীমা (২০১৭ সাল পর্যন্ত) বেঁধে দেওয়ায় তারা ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় আদালতে রিট করেন। সেই রিটের শুনানিতে উঠে আসে—ভিকারুননিসা বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে যে নিয়ম দিয়েছিল, তা নিজেরাই লঙ্ঘন করেছে। এ নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।
[১৬] ভিকারুননিসা নিজেদের ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতির নিয়ম মানেনি। সেজন্যই এ জটিলতা। মাউশির কিছু বলার নেই। আদালতেই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী
[১৭] আদালতের রুলের পর মাউশি ২০১৫ সালে জন্ম নেওয়া ১০ জন এবং ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া ১৫৯ জনসহ মোট ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করতে ভিকারুননিসাকে নির্দেশনা দেয়। একই সঙ্গে শূন্য হওয়া আসনে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তির নির্দেশ দেয়। ভিকারুননিসা ভর্তি বাতিল করলে বন্ধ হয়ে যায় শিশুদের স্কুলে যাওয়া। এরপর ভর্তি বাতিল হওয়া শিশুদের অভিভাবকরা আপিল বিভাগে যান। সেখান থেকে দুই মাসের জন্য স্থিতি অবস্থা দেন আদালত। এতে ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলই থাকে। কিন্তু নতুন করে তাদের জায়গায় শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বিষয়টি বিচারাধীন।
[১৮] দুই পক্ষের এ আইনি লড়াই দীর্ঘ হতে পারে মনে করেন মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরা। ২১ মে শুনানির তারিখ রয়েছে।এদিন আদালত থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অভিভাবকদের পক্ষে রিট করেন আইনজীবী শামীম সরদার। তিনি বলেন, ভিকারুননিসা নিজেরা নিয়ম করে সেটা আবার নিজেরাই ভঙ্গ করেছে। এ কারণে আমরা রিট করি। আদালতে রুল জারি করে মাউশির কাছে জানতে চান, কেন এটা (২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুকে ভর্তি) অবৈধ হবে না। মাউশি যখন দেখলো—অনিয়ম হয়েছে, তখন তারা ভর্তি বাতিলের নির্দেশনা দিলো। চূড়ান্ত রায় আমাদের পক্ষে আসবে বলে আমরা মনে করি।
[১৯] তবে ভর্তি বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন,বিজ্ঞপ্তিতে যাই থাকুক না কেন,লটারিতে শিক্ষার্থীদের ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তির নির্দেশ দিয়েছে মাউশি। এরপর ভিকারুননিসা জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখেই ভর্তি করিয়েছে। বয়সের ঊর্ধ্বসীমা কত হবে, সেটা তো স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে।
[২০] ভিকারুননিসা যদি গভর্নিং বডির মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শিশুদের ভর্তি করাবে তাহলে এখানে মাউশি বা অন্য কারও ভর্তি বাতিলের নির্দেশনা দেওয়ার তো সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা আদালতে তুলে ধরছি। এটি এখনো শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি, আইনিভাবে রায় আমাদের পক্ষে আসবে।
[২১] ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা (মাউশি) ও ভিকারুননিসার শিক্ষকরা। আদালতে বিচারাধীন থাকায় এ নিয়ে কেউ গণমাধ্যমে মন্তব্য করতে রাজি নন। একই সঙ্গে মানবিক বিষয় হলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন তারা।
[২২] ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, আমরা গভর্নিং বডিতে আলোচনা করে এবং মাউশিকে অবগত করেই ১৬৯ শিশুকে ভর্তি করেছিলাম। পরে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। সেজন্য এটা নিয়ে বেশি কথা বলা উচিত হবে না।
