ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্তে কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে?
ড. ফাহমিদা খাতুন
ব্যাংক একীভূতকরণের আশেপাশের কথোপকথনটি ধারণাটি প্রথম চালু হওয়ার পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই পিছনের আসন নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার অ-পারফর্মিং ঋণ হ্রাস ও উন্নতিসহ অর্থনীতির স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রয়াসে বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। সাধারণভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের কর্মক্ষমতা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে। এই কাঠামোর অধীনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ক্যাপিটাল টু রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর), নেট নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স সহ নির্বাচিত প্যারামিটার সূচকগুলোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত সংশোধনমূলক পদক্ষেপের একটি সময়সূচী সম্পাদন করতে হবে। পরবর্তীতে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করে।
ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগের অংশ হিসেবে, এক্সিম ব্যাংক কেলেঙ্কারির পদ্মা ব্যাংক, পূর্বে ফারমার্স ব্যাংক নামে পরিচিত। যেটি ২০১৭ সালে তারল্য সংকটের কারণে পতনের দ্বারপ্রান্তে ছিলো তার দখল নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। সরকার ব্যাংকটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছে ও ইনজেকশন দিয়েছে। ২০১৮ সালে চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। তবে, পদ্মা ব্যাংক এখনও রক্তাক্ত ও উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে, অন্য যেসব ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো তারা দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত হতে অনীহা দেখিয়েছে। কিছু ব্যাংকের কর্মচারীরা চাকরি ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি নিয়ে একীভূতকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রকাশ করেছে। একীভূতকরণ উদ্যোগে সাময়িক বিরতি ভালো হতে পারে কারণ একীভূতকরণ দীর্ঘ ও কঠিন প্রক্রিয়া যার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, স্বচ্ছতা প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে সংযুক্তি হতে পারে না। এটি ভালো পারফরম্যান্সকারী ব্যাংকগুলোর উপর দরিদ্র ব্যাংকগুলোর দায় চাপানোর পরিমাণ। ভালো ব্যাংকগুলো তাদের কাঁধে এমন একটি বোঝা নিতে শঙ্কিত হবে যার জন্য তারা দায়ী নয়।
এছাড়া একীভূতকরণের নির্দেশনায় বলা হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকরা পাঁচ বছর পর শক্তিশালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য হতে পারবেন। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিলো ব্যাংকগুলোর দুর্বল অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি করা। শক্তিশালী ব্যাংকের বোর্ডে তাদের পুনঃস্থাপনের বিধান হলো একটি অর্জিত পুরস্কার। একীকরণ সফল হওয়ার জন্য সঠিক আর্থিক প্রতিবেদন অপরিহার্য। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বস্তুনিষ্ঠভাবে চিহ্নিত করা ও ব্যাপক যথাযথ অধ্যবসায় গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য, লাভজনকতা, সম্পদের গুণমান, তারল্য, মূলধন, দায়, আইনি সমস্যা ও সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন জড়িত। সংযুক্তিগুলোকে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। একটি শক্তিশালী ব্যাংকের একটি দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প থাকা উচিত শুধুমাত্র যদি এটি ব্যাপক আর্থিক ও অ-আর্থিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুস্পষ্ট সুবিধার প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি একটি শক্তিশালী ব্যাংককে একটি দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে বাধ্য করে। বিনিময়ে শক্তিশালী ব্যাংককে কোনো বিশেষ নীতি ও নিয়ন্ত্রক সহায়তা প্রদান করা হয়, তাহলে সেই ব্যাংকগুলো আগ্রহী হবে। এটি ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন সমস্যা তৈরি করবে কারণ সরকারের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদী লাভের দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে।
আরেকটি সমস্যা হলো যে ব্যাংক একীভূতকরণ কার্যক্রমকে স্ট্রিমলাইন না করে ভালো ফলাফল দিতে পারে না, যার মধ্যে ডুপ্লিকেট চাকরি বাদ দেওয়া জড়িত। সুতরাং, ছাঁটাইয়ের অনিবার্য ঝুঁকি রয়েছে, বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকের কর্মীদের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য নির্বাচিত দুর্বল ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি যাদের চাকরি একীভূত হওয়ার পরে বহাল থাকবে তাদেরও নতুন সংগঠনের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগবে। কর্মচারী একীকরণের ঝুঁকি রয়ে গেছে ও এটি সামঞ্জস্য করতে অনেক সময় লাগতে পারে। দুটি ব্যাংককে একীভূত করাও একটি জটিল প্রক্রিয়া কারণ আইটি সিস্টেমগুলোকে একীভূত করতে হবে, বিশেষ করে ব্যাংকগুলোতে প্রযুক্তির অসম গ্রহণের সঙ্গে। ক্রিয়াকলাপে ব্যাঘাত, সামঞ্জস্যের অভাবের কারণে ডেটা সুরক্ষার ঝুঁকি এসবই সম্ভাবনা। অতএব, দুটি ব্যাংকের নির্বিঘ্ন প্রযুক্তিগত একীকরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও কার্যকর করা আইটি কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তিও ছিলো। কারণ তারা স্পষ্ট ছিলো না যে তাদের অ্যাকাউন্ট, আমানত ও পরিষেবার মানের কী হবে যখন তাদের ব্যাংকগুলো অন্য কোনও ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ব্যাংক একীভূত করা কঠিন ও মিশ্র ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। একটি সফল একীভূতকরণের চাবিকাঠি হলো একীকরণের সুস্পষ্ট কৌশলগত পদ্ধতির মধ্যে যা কর্মক্ষম দক্ষতা ও গ্রাহক সন্তুষ্টি উভয়কেই অগ্রাধিকার দেয়। অতীতের ব্যাংক একীভূতকরণ থেকে বাংলাদেশের কিছু শিক্ষা রয়েছে যেখানে সফল ও ব্যর্থ উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। সেই উদ্যোগগুলো থেকে যে শিক্ষা নেওয়া হয়েছে তা বিবেচনা করতে হবে যা নিয়ন্ত্রক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক প্রকৃতির। মনে রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে একটি ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের একীভূতকরণ দুটি পৃথক বাস্তুতন্ত্রকে একীভূত করার একটি অনুশীলন, যদিও তারা একই খাতের অন্তর্গত। এই নিয়ন্ত্রক ল্যান্ডস্কেপ নেভিগেট করার জন্য সূক্ষ্ম পরিকল্পনা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এসব বিবেচনায় রাখতে হবে।
একত্রীকরণকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত নয়। একীভূতকরণের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত সেক্টরের স্বাস্থ্যের উন্নতি, যা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যদিও ব্যাংকের সংখ্যা, অর্থায়নের উপকরণ, সম্পদ ও ঋণের পরিমাণের দিক থেকে খাতটি সম্প্রসারিত হয়েছে, তবুও খাতের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা অবনতি হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বল স্বাস্থ্য উচ্চ পরিমাণের এনপিএলের সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো প্রায় ১৪৫,৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ৯ শতাংশের সমান, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিলো ৮.২ শতাংশ। ব্যাংকিং সেক্টরে এই ধরনের দুর্বলতা বেশ কয়েকটি ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অসদাচরণ ও দুর্নীতির ফলাফল। বিশেষ করে যেগুলোকে রাজনৈতিক ভিত্তিতে কোনো সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন ছাড়াই পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিলো। ২০১৩ সালের ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই ধরনের ব্যাংকগুলোর প্রয়োজন ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এই নীতি মানা হয় না। রাজনৈতিক প্রভাব প্রায়ই অর্থনৈতিক যুক্তিকে ছাড়িয়ে যায়। ফলস্বরূপ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য লাইসেন্স প্রদান আপাতদৃষ্টিতে জনসাধারণের তহবিলের অপব্যবহার করার একটি উপায় হয়ে উঠেছে। যদিও সফল একীভূতকরণ এনপিএল হ্রাস ও উন্নত দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারে, ব্যাংকিং সেক্টরের মূল ইস্যুটি কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের উন্নতি ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। লেখক : সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ও আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ডেইলি স্টার