
বিদেশে স্বল্প-দক্ষতা, স্বল্প-আয়ের চাকরিতে কেন আটকে আছেন বাংলাদেশিরা?
নিজস্ব প্রতিবেদক : [১] ২০২২ এবং ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রবাসে গেলেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২১ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
[২] বিগত কয়েক বছরে বিদেশে পাঠানো ২৪ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে ৬০ শতাংশই স্বল্প-দক্ষ চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন। ২২ লাখেরও বেশি ব্যক্তি প্রবাসে কর্মসংস্থানের জন্য নতুন করে নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ এমনকি মাধ্যমিকের পাঠও চোকাননি। এদের বেশিরভাগকেই কম বেতনের চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সূত্র : টিবিএস
[৩] বিদেশে চাকরিপ্রত্যাশীদের ওয়ান-স্টপ পরিষেবার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমি প্রবাসী’ অ্যাপ্লিকেশনের অনলাইন নিবন্ধন তথ্য অনুসারে, এসব ব্যক্তির সবচেয়ে কাঙ্খিত চাকরির মধ্যে রয়েছে শ্রম, সাধারণ কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হোটেল বয়, বিক্রয়কর্মী এবং নির্মাণ শ্রমিক। চাকরিপ্রার্থীদের সহায়তার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অ্যাপটি তৈরিতে সহায়তা করেছে। [৪] শীর্ষ ১০ পছন্দের চাকরির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রবাসে চাকরি প্রার্থীদের ৮৮ শতাংশ নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষা ও দক্ষতা প্রয়োজন হয় এমন ৮টি চাকরিকে বেশি বাছাই করেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ চালক ও ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে চেয়েছেন।
[৫] অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের সরবরাহ অনেক বেশি। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার এবং কুয়েতের মতো গন্তব্যে তাদের ভালো চাহিদা রয়েছে। এ দেশগুলো বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের ৯৪ শতাংশের পছন্দের গন্তব্য। [৬] ২০২২ সাল থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর অধীনে বিদেশে যাওয়ার জন্য অনলাইনে নিবন্ধনকারীদের শীর্ষ ১০ পছন্দের গন্তব্যে মধ্য-প্রাচ্যের বাইরে কেবল ইতালি রয়েছে। এসব আবেদনকারীর প্রায় ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪০। [৭] প্রবাসে চাকরিপ্রত্যাশীদের তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কীভাবে বাংলাদেশিরা কয়েক বছর ধরে স্বল্প-দক্ষ চাকরির চক্রে আটকে আছেন। ফলে এক কোটিরও বেশি অভিবাসী কর্মী থাকা সত্ত্বেও কম রেমিট্যান্স আসছে দেশে। [৮] অভিবাসীর উৎস দেশ হিসেবে পাকিস্তান এবং ফিলিপাইন উভয়ই বাংলাদেশের পেছনে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সর্বশেষ বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন ২০২৪ অনুসারে রেমিট্যান্স আয়ে এ দুই দেশ এগিয়ে রয়েছে।
[৯] বাংলাদেশ অভিবাসী-উৎস ও রেমিট্যান্স পাওয়া দেশ হিসেবে যথাক্রমে ষষ্ঠ এবং অষ্টম স্থান ধরে রেখেছে। অন্যদিকে অভিবাসী শ্রমিক পাঠানো ও রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তান যথাক্রমে সপ্তম ও ষষ্ঠ এবং ফিলিপাইন যথাক্রমে নবম ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
[১০] বাংলাদেশিদের নিয়তি কেন স্বল্প বেতন, গত বছর রেকর্ড ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। বিএমইটি-এর তথ্য অনুসারে, তাদের মধ্যে দক্ষ অভিবাসন ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক ছিলেন প্রায় ৫০ শতাংশ। বাকিরা আধা-দক্ষ এবং পেশাদার ছিলেন।
[১১] অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী দক্ষতার চাহিদার অভাব নেই, তবে বাংলাদেশিরা তা ধরতে পারছেন না। তারা কম বেতনে স্বল্প-দক্ষ চাকরিতেই থেকে যাচ্ছেন। বৈশ্বিক চাকরির বাজারের জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
[১২] আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২৫ সালে শেষ হবে। সেখানে দক্ষতা উন্নয়ন এবং ডিজিটালাইজেশনের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে অভিবাসন নীতিতে একটি প্যারডাইম শিফটের রূপরেখার কথা বলা হয়েছে। তবে পরিকল্পনাটি শেষের দিকে পৌঁছালেও আমরা এখনও এ ধরনের কোনো শিফট দেখতে পাচ্ছি না, বলেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) পরামর্শক আসিফ মুনির।
[১৩] প্রশিক্ষণের খারাপ অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যদিও অসংখ্য নতুন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমি গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি পরিদর্শন করেছি এবং দেখেছি যে, কয়েকটি নিছক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই আছে। ওগুলোতে কেবল ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষকেরাও আধুনিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন।
[১৪] বর্তমানে বিএমইটি সারাদেশে ১১০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) পরিচালনা করছে। আগের ৭০টি কেন্দ্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন করে আরও ৪০টি কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। কিছু পুরোনো টিটিসিতে প্রশিক্ষণ যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। আবার অনেকগুলোতে সঠিক প্রশিক্ষণই প্রদান করা হয় না, মুনির বলেন।
[১৫] অভিবাসীদের জন্য তিনদিনের বাধ্যতামূলক প্রি-ডিপারচার ওরিয়েন্টেশনকে অকার্যকর অভিহিত করে তিনি বলেন, একটা কক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে জড়ো করে বিদেশে কী করতে হবে সে নিয়ে লেকচারের মতো করে উপস্থাপনা প্রদান করাকে প্রশিক্ষণ বলা যায় না।
[১৬] ভাষাদক্ষতার অভাবও বাধা, বর্তমান ভাষার পাঠ্যক্রমের ত্রুটি তুলে ধরে মুনির বলেন, কয়েক দিনে ইংরেজি শেখা সম্ভব নয়। তাই আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষাদান পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পাঠ্যক্রম সংশোধন করা প্রয়োজন।
[১৭] অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশ গুলোতে যারা কাজ করছেন তারা দুর্বল ভাষাদক্ষতার কারণে গুরুতর যোগাযোগ সমস্যার সম্মুখীন হন। এটি তাদের আয় এবং জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
[১৮] প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ৫২ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক ভাষার বাধাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের চাহিদার বিষয়ে শ্রমিকদের যোগাযোগ করতে অক্ষমতা তাদের শোষণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
[১৯] অভিবাসী শ্রমিকেরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে প্রয়োজনীয় ফ্যাসিলিটি পেতে এবং বিচার চাইতে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েন বলে জানান তারা। অভিবাসীরা তাদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো চিকিৎসকদের কাছে ব্যাখ্যা করতেও হিমশিম খান। ফলে রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে না হওয়া এবং যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
[২০] প্রতিযোগী দেশের রেমিট্যান্সের অর্ধেকেরও কম, বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে স্বল্প মজুরির শ্রমের একটি প্রধান উৎস। ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় কর্মীপ্রতি কম রেমিট্যান্স পায় এটি।
[২১] আইওএম-এর ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে, একজন বাংলাদেশি প্রবাসীর পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্স ২০৩.৩৩ ডলার, যেখানে একজন ফিলিপিনো শ্রমিক তার দেশে পাঠান গড়ে ৫৬৪.১ ডলার।
[২২] একজন পাকিস্তানি প্রবাসীর মাসিক গড় আয় ২৭৫.৭৪ ডলার। অন্যদিকে একজন ভারতীয় মাসে ৩৯৫.৭১ ডলার এবং একজন চীনা নাগরিক ৫৩২.৭১ ডলার আয় করেন।
[২৩] দক্ষ কর্মী পাঠাতে আমাদের অক্ষমতার অর্থ এই না যে এ ধরনের শ্রমিকদের বিদেশে চাহিদার অভাব রয়েছে। ফিলিপাইন, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে দক্ষ শ্রমিকের উচ্চ চাহিদা মেটানো হচ্ছে, বলেন বিএমইটি’র সাবেক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) এবং সরকারের কর্মসংস্থান বিনিয়োগ কর্মসূচির (এসইআইপি) দক্ষতা বিষয়ক উপদেষ্টা নুরুল ইসলাম।
[২৪] তিনি বলেন, গত বছর ১৩ লাখ লোক অভিবাসন করলেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। একদিকে তাদের মজুরি কম, অন্যদিকে তাদের উপার্জনের একটি বড় অংশ চলে যায় ঋণ পরিশোধে। এছাড়া অনেক অভিবাসী যাওয়ার পরে কাজ খুঁজে পান না।
[২৫] কম দক্ষ কর্মীদের উৎসদেশ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিএমইটি এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার অভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যমান প্রশিক্ষণ সুবিধাসমূহ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
[২৬] সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। দক্ষতা-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সুপরিচিত হলেও এগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই, বলেন নুরুল ইসলাম। আমরা পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মী তৈরি করছি না। আইএলও-এর দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশি শ্রমিকেরা চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বিদেশে চাকরির জন্য উপযুক্ত নয়। রিক্রুটিং এজেন্সি বা বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের মাধ্যমে আসা বেশিরভাগ ভিসা অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য, বলেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী।
[২৭] নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটি’র একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য সক্ষমতা তৈরির একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
[২৮] টিটিসিতে নিম্নমানের সরঞ্জাম এবং জনবলের বিষয়ে বিএমইটি’র পরিচালক (প্রশিক্ষণমান ও পরিকল্পনা) মো. আকরাম আলী বলেন, যদিও পুরানো টিটিসিগুলো সুসজ্জিত, তবে নতুনগুলোর জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কিছু নিয়োগ করা হয় বলে এটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ।
