
অফশোর ব্যাংকিং, অফশোর একাউন্ট ও পেনশন স্কিম

কাজী এম. মুর্শেদ
ব্যাংকে আপনি আমানত রাখেন, একটা সুদ পান। সেই টাকা ব্যাংক উদ্যোক্তাদের যাচাই বাছাই করে ঋণ দেয়, এবং সুদ পায়। বর্তমানে সুদের হার ব্যাংকের ওপর ছাড়ার আগে এই হার ছিলো নয়-ছয়, সেই উদাহরণ দিয়ে বলি। ব্যাংক আপনার কাছ থেকে আমানত বা ডিপোজিট নেবে এবং সুদ বা ইন্টারেস্ট দেবে ৬ শতাংশ হারে। আপনার আমার টাকা উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের ঋণ বা লোন দেবে এবং সুদ পাবে ৯ শতাংশ হারে। ব্যাংকের লাভ এই ৩ শতাংশ। বড় অংকের লেনদেন হয়, ৩ শতাংশ কোনো ছোট সংখ্যা না। এবার মনে করেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিলো। ব্যাংক যা করবে তা হলো যতো কম সুদ দিয়ে পারে আমানত নেবে, যতবেশি সম্ভব সুদ নেবে ঋণগ্রহিতার কাছ থেকে। আগের নয়-ছয় সব ব্যাংককে একটা নীতিতে রাখতে সক্ষম ছিলো, এখন সেই ক্ষমতা নাই, আপনারে ৮ শতাংশ দেবে আর ঋণ দেওয়ার পর ১৬ শতাংশ নেবে, এখন সেই ৩ শতাংশ আর হাতে নাই, ৮ শতাংশ হলেও আপনি মানবেন। আপনার যদি মনে হয় ৬ থেকে ৮ মানে আপনার ২ শতাংশ লাভ হলো, বাস্তবে ক্ষতি অনেক বেশি। ব্যাবসায়ীদের পন্য বা সেবা নেবেন, যারা এখন অতিরিক্ত ৭ শতাংশ সুদ দিতে বাধ্য, নিশ্চয়ই বাসা থেকে আপনাকে সাবসিডি দেবে না, এই বোঝা আপনার আমার কাঁধে এসে পরবে।
এবার অফশোর ব্যাংকিংয়ে আসি। আপনি দেশে বসে অফশোর একাউন্ট খুলবেন। উদ্দেশ্য হলো, দেশে একাউন্ট খুললেও টাকা জমা হবে বিদেশ থেকে, আপনি আপনার বিদেশের আত্মীয়র এখানে নমিনি, কোনো টাকা রাখার কথা না। সুবিধা হলো, থিওরিটিকালি এটা হুন্ডি ব্যবসার লাগাম টানবে, আর অসুবিধা হলো, টাকা হুন্ডিতে বাইরে যাবে, বিদেশে গিয়ে সেখান থেকে দেশের ব্যাংকে ডলার জমা হবে। আপনি হুন্ডিতে টাকা আসা বন্ধ করতে পারলেন কিন্তু টাকা যাওয়া বাড়তে দিলেন। এই অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। আপনারা পানামা পেপারের কথা জানেন, এরপর প্যারাডাইস পেপারের কথা জানেন, শেষবার নিশ্চয়ই প্যান্ডোরা পেপারের কথা শুনেছেন। অফশোর ব্যাংকিং হলো কিছু দেশে টাকা রাখা, যারা ভালো সুদ দেয়, ট্যাক্স কাটে না, এবং গোপনীয়তা বজায় রাখে।
বিভিন্ন দেশের বড় বড় মাফিয়া বলেন বা টাকার পাহাড় যারা অবৈধ উপায়ে আয় করে, তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে এইসব অফশোর ব্যাংকে টাকা রাখে। টাকা নিরাপদে থাকে, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কিখাতে এই টাকা ইনভেস্ট করে চড়া সুদ দেয় তার কোনো হিসাব পাবেন না। লোকেশন অনুযায়ী কিছু ধারণা করতে পারেন, যেমন কেইম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ড, ম্যান অফ আইলস, গায়না, বারবাডোস, সেন্ট নেভিস ও কীটস ইত্যাদি। যেখানে আমেরিকার ব্যাংকগুলো ২.৫ শতাংশের উপর সুদ দিতে পারে না, সেখানে অফশোর ব্যাংক কীভাবে চড়া সুদ দেয় যেসব দেশ শুধু পর্যটক নির্ভর? তার কারণ পানামা পেপার যেহেতু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বের হয়, এর সাথে ড্রাগসের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। অন্য ক্ষেত্রে কুইক মানির রাস্তা আছে ক্যাসিনো ব্যবসায় এবং সবচেয়ে বড় সোর্স বেটিং থেকে। অফিশিয়ালি কিছু টাকা তারা নিউইয়র্ক স্টক একচেঞ্জে খাটায়, সেটা পাঠাতে আবার আমেরিকায় শেল একাউন্ট খোলে। শেল মানে ঝিনুক, যার নাম পরিচয় গোপন থাকে। যেমন ধরেন ডনাল্ড ট্রাম্প তার বিভিন্ন কেলেংকারি ধামাচাপা দিতে হাশমানি বা চুপ থাকার অর্থ এই শেল একাউন্ট থেকে দিয়েছিলো।
এবার আসেন কিছু হয়তো ধরতে পারছেন অফশোর একাউন্ট সম্মন্ধে, বেশির ভাগ দেশেই অফশোর একাউন্ট গোপনভাবে রাখা হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো, তারা আইন করে এখন পরিচয় বলে দিতে বাধ্য, যদি সরকার চায়। বাংলাদেশ সরকারের ধারণা আছে কাদের অর্থ আছে, সেজন্য কখনো তথ্য চায় না। অন্য ডেস্টিনেশনগুলোও এখন নিয়মে চলে আসছে, সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের ব্যাংকে রাখতে গেলে শুধু পরিচয় প্রকাশ না, টাকা কোন একাউন্ট থেকে কী কারণে এসেছে প্রমাণ না করলে টাকা রাখবে না। সরকার চাইলে নাম, অংক সব বলে দেয়, সাথে সুদ দেয় না, ট্যাক্স কাটে এবং সন্দেহজনক লেনদেন হলে সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বর্তমান গন্তব্য এখন আগে যেগুলো বললাম সেখানে। যারা এসব এলাকায় থাকে কেমন আছে? ধরেন ম্যান অফ আইলস ছোট দ্বীপ ইংল্যান্ডের পাশে, এদের মাথাপিছু আয় ৪০-৫০ হাজার ডলার, তেমন কোনো কাজ নেই বলে কনসার্ট করে আর খায় দায় ঘুমায়। এক কথায় স্বর্গ সুখে আছে অন্যের টাকায় সেটা বিভিন্ন লিগাল ও ইললিগাল সোর্সে ইনভেস্ট করে। আমাদের কনটেক্সটে আসি।
এই যে ৩০ জন ব্যাংকের এমডিসহ ৪৫ জন, মাথা পিছু ১৩ হাজার ডলার খরচ করে যাবে, নিউইয়র্ক গিয়ে ৫৫ হাজার ডলার খরচ করে অনুষ্ঠান করে অফশোর ব্যাংকিং লঞ্চ করবে, এটা একদিকে অনেকের ভাগ্য বদলে দেবে। অনেকের মানে যারা অবৈধ অর্থ জমা করে বা লুকিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সিন্দুকে রাখে তাদের জন্য। আমেরিকার ব্যাংক আপনাকে ২.৫ শতাংশের ওপর সুদ দেবে না, কোনো সন্দেহজনক লেনদেন ঘটাবে। এখন সেইটাও কাটানো সম্ভব। অফশোর একাউন্টে রাখলে ৮ শতাংশ সুদ আসবে, ট্যাক্স রিবেট পাবে, সবচেয়ে বড় ব্যাপার, টাকাটা ৫ বছর পর সুদসহ বিদেশে নিতে পারবে। আমাদের সরকারের লাভ হলো, বিদেশি ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ দেখাতে পারবে। তবে পাঁচ বছর হয়ে গেলে ডলার যখন শোধ করতে হবে, আজকের অনেকেই যারা আইন করছে তারা হয়তো জীবিত থাকবে না, বা অবসরে যাবে। আমেরিকার ব্যাংকে একটা বড় লেনদেন হলেই সরকার খপ করে ধরবে এবং মামা, তখন খবর আছে।
আমাদের বৈদেশিক আয়ের রপ্তানি কমা, হুন্ডি বৃদ্ধি, রেমিটেন্স আসা কিছু কমা, পর্যটন আয় না বৃদ্ধি, ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট আরো কমা বিশেষ করে ইকোনোমিক জোন মোটামুটি ব্যর্থ হওয়ার পর অন্য রাস্তা ধরা এবং সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি যেমন পোর্ট ও যাতায়তের তেল সরবরাহ না চলা, সবকিছু ছাপিয়ে এই অফশোর ব্যাংকিং সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হবে। দেশের ব্যাংকগুলো যখন সরকারের সাথে নিশ্চয়তা দেয় ৮ শতাংশ সুদ পাবে এবং ৫ বছরপর টাকা বাইরে নিয়ে যেতে পারবে, ট্যাক্স রিবেট পাবে, আমি দিব্য চোখে দেখছি কতো দেশি কালো টাকার মালিক হুন্ডির লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। কালো টাকা বাইরে এতো সহজে পাচার করে সাদা বানানোর অন্য কোনো রাস্তা কোনো দেশ দেবে না।
সমস্যা কোথায় জানেন? এই ডলার জমা রাখার পর ৮ শতাংশ সুদ যে দেবে, কোন খাতে খাটাবে? অফশোর একাউন্ট যাঁদের আছে, তাদের বিরাট ইনভেস্ট করার লিগ্যাল ও ইললিগ্যাল পথ আছে, আমাদের আছে একগাদা ঋণখেলাপি। টাকা ফেরত যাবার সময় যেই বিশৃঙ্খলা সৃস্টি হবে, সেটাও দেখতে পারছি। বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির কনফারেন্স দেখেছেন? যেসব ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী এতোদিন গুণগানে ব্যস্ত ছিলো, তাঁরাও সর্বজনীন পেনশনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় আমার হতাশার কথা বলেছিলাম পেনশন স্কিম কাজ করবে না। একইভাবে বলছি অফশোর একাউন্টের শুরু এবং শেষ দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি। আপনারা চোখ খোলেন, বুঝবেন ৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকার এই বিদেশ ভ্রমণ পুরোটাই লস প্রজেক্ট। এর আগেও কয়েকদফা বিদেশ গিয়ে ইনভেস্টমেন্টের ফরিয়াদ করে আসছেন বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও সিকিউরিটি এক্সচেন্জ কমিশন প্রধান। শেয়ারবাজারে কিছু কালো টাকা ছাড়া কিছুই আসেনি, বরং ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট সরকারি হিসাবে কমে গেছে। যাই হোক, কালো টাকার মালিক, আপনাদের স্বপ্নের-স্কিম আসছে, অভিনন্দন আপনাদের।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
