দক্ষিণ এশিয়ায় চীন সবখানে সহযোগিতার দু’হাত প্রসারিত করে আছে
জগদীশোর পান্ডে : বারো বছর আগে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভস (বিআরআই) ছিলো না। গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস (জিডিআই), গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভস (জিএসআই) ও গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভস (জিসিআই) এর মতো কোনও প্রচেষ্টা ছিলো না। বিশ্বের কোনো বড় মাপের চীনা বিনিয়োগকৃত অবকাঠামো ছিলো না- বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, রাস্তা, স্কুল, জলবিদ্যুৎ, রেলপথ ও বিশ্বের অন্যান্য সংস্থা। চীনা কূটনীতি ছিলো নরম ও নীরব। চীন আসার আগে দক্ষিণ এশিয়া প্রধানত ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। ১২ বছর পর ড্রাগন দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ও এক নম্বর অবস্থানের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। চীনারা সক্রিয় ও আক্রমণাত্মক কূটনীতির দ্বারা আরও প্ররোচিত হয়েছে যা ভারতীয়, পশ্চিমা শক্তিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করে আসছে। মজার বিষয় হলো ভারত ও ভুটান বাদে সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ চীনের উচ্চাভিলাষী প্রোগ্রাম বিআরআই-এর অংশ। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অনেক অবকাঠামো তৈরি করেছে, শ্রীলঙ্কায় উল্লিখিত ঋণ-ফাঁদ সহ বিতর্ক উত্থাপন করেছে। বেইজিং ও অন্যান্য দেশের মধ্যে বহু সফর বিনিময় হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দক্ষিণ এশিয়ায় কোন শি জিনপিং চিন্তাধারার আগমন ঘটেনি যা আমরা নেপালে ২০১৯ সালের অক্টোবরে দেখেছি। এখন এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো। এই বছরের ২০২৪ এর শুরুতে চীন নেপালে প্রথম আনুষ্ঠানিক চীনা নববর্ষ উৎসব উদযাপন করে। এই প্রথম চীন তাদের নববর্ষ উদযাপন বড় ভলিউম ছিলো। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন: কোথাও থেকে সর্বত্র অনুষ্ঠানটিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুস্প কমল দাহাল অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী দাহাল বলেন, নেপাল ও চীন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বিশ্বস্ত বন্ধু। দাহাল আরও বলেন, নেপাল এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী একটি দেশ নেপালে চীনা স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকলাপ হতে দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বছরের প্রথম মার্চ, মালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর অধীনে চীনের সঙ্গে একটি সামরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটা বলা হয়েছে যে এই চুক্তি শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর কৌশলগত পদক্ষেপ বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। মালদ্বীপ এখন চীনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার। হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দরের ৯৯ বছরের ইজারা নিয়ে শ্রীলঙ্কায় চীনের পায়ের ছাপ বিশ্বব্যাপী শিরোনাম হয়েছে। একে ঘৃণ্য ফাঁদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চীন বিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে দেয়।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসের বন্দরটি ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত তাকে অজনপ্রিয় করে তুলেছিলো। যদিও তিনি ও তার ভাই মদিন্দ্র রাজাপাকসের সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। রাজাপাকসে যিনি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ও আরও চীনা বিনিয়োগ এনেছিলেন। বেইজিং কলম্বোর অর্থনৈতিক সংকটকে গভীরতর করতে সহায়তা না করার পরে সমস্যায় পড়েছিলেন। পাকিস্তান ও চীন ২০১৫ সাল থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। ইসলামাবাদ একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বেইজিং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর, বিআরআই-এর অধীনে কৌশলগত সড়ক করিডোরের একটি লুপ স্বাক্ষর করার পরে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধন ভাগ করে নেয়। পাকিস্তান সরকারের মতে, প্রকল্পটি ২০ এপ্রিল ২০১৫-এ চালু করা হয়েছিলো, যখন চীনা রাষ্ট্রপতি শি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ৫১টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন যার মূল্য ৪৬ বিলিয়ন ডলার। প্রকল্পটি এখনও সমাপ্তির মুখ দেখেনি। অন্যদিকে, তিব্বতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা ও নির্বাসিত তিব্বত সরকার ধর্মশালায় অবস্থান করার কারণে চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সবসময়ই সন্দিহান ছিলো।
বাংলাদেশ ২০২৩ সালে চীনের সঙ্গে সহযোগিতার একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব সম্পন্ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি শির সঙ্গে নতুন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উন্নয়নে আলোচনা করেছেন। চীন সবসময় বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সমর্থন দিয়েছে ও ঢাকার সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনেও সমর্থন দিয়েছে। চীন আজকাল ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শকেও সমর্থন করে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও জয়-জয় সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। যার ফলে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মেগা অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে।
চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য বিভিন্ন অন্যান্য উদ্যোগও শুরু করেছে। চীন যেটি করোনার সময় তার সমস্ত সীমান্ত অবরুদ্ধ করেছিলো ও এখনও সব খুলে দেয়নি। নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সহযোগিতায় এই অঞ্চলে ভারতকে মোকাবেলা করতে ‘হিমালয়ান কোয়াড’ নিয়ে এসেছিলো। মজার বিষয় হলো চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য একটি নতুন কৌশল নিয়ে এসেছিলো যা বেইজিং প্লাস তিনটি তিব্বত, চেংডু ও চংকিং সিটি। গত এক দশকে আমরা বেইজিং সহ এই তিনটি স্পটের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের আরও বেশি ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি। ২০২১ সালে চীন চংকিং শহরে চীন-দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন ও সমবায় উন্নয়ন কেন্দ্র চালু করেছে। তদুপরি, চীন-দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জরুরি সরবরাহ সংরক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণও দেখায়। আমরা যদি গত ১২ বছরে এই পরিবর্তনগুলো দেখি তবে আমরা বলতে পারি যে চীন এখন দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র আগে কোথাও নেই।
লেখক: উপ-প্রধান উপ-সম্পাদক, কান্তিপুর দৈনিক, নেপাল। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান