![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)
বিশ্বের ১২ বিলিয়ন প্রাণি ও উদ্ভিদের ৪৯ মিলিয়ন প্রজাতির আবাসস্থল
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/uploads/2024/05/Md-Zillur-Rahaman.jpg)
মো. জিল্লুর রহমান : প্রতি বছর ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালন করা হয়। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ও এটি সম্পর্কে কী করতে হবে তা নির্ধারণে দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। দিনটি ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৩ এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২২ মে, ২০০২ তারিখে পুনঃনির্ধারণ করে যখন অনেক দেশ বিভিন্ন ছুটির কারণে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দিবসটি উদযাপন বন্ধ করে দেয়। মূলত ২২ মে, ১৯৯২ কেনিয়ার নাইরোবিতে জীববৈচিত্র্যের কনভেনশন দ্বারা আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলো। আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডার জাতিসংঘের সাসটেইনেবল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় পড়ে। জীববৈচিত্র্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সাসটেইনেবল কৃষি, মরুকরণ, জমির অবক্ষয়, খরা, জল, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, সাসটেইনেবল উন্নয়ন, শক্তি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, জ্ঞান ভাগাভাগি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, শহুরে স্থিতিশীলতা, অভিযোজনযোগ্যতা, সাসটেইনেবল পরিবহন, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, মহাসাগর, সমুদ্র, বন জঙ্গল, আদিবাসীরা খাদ্য নিরাপত্তায় অংশীদারিত্বে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য বৃহত্তর উদ্যোগ নিয়েছে।
আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি প্রতিটি প্রাণী একে অপরের উপর নির্ভরশীল প্রতিটি প্রজাতির এই ইকোসিস্টেমে খেলার জন্য আলাদা ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি জীবন্ত জিনিসই পরিবেশের জন্য কোনো না কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই জীবজগতের ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে সকল জীবকে বাঁচতে দিতে হবে। মানুষই অন্য প্রজাতির বিলুপ্তির একমাত্র কারণ নয় তাদের কার্যক্রম যদি এদিক দিয়ে চলতে থাকে তাহলে আমরা আসলে মানবজাতির বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবো। সহজ কথায়, এই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণী বাস করে যাকে বলা হয় জীববৈচিত্র্য ও বিজ্ঞানের পরিভাষায় জীববৈচিত্র্য হলো উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব, তাদের জিন ও তাদের দ্বারা গঠিত বাস্তুতন্ত্র সহ পৃথিবীর সমগ্র জীববৈচিত্র্য। শুষ্ক মরুভূমি থেকে বন, তুষারাবৃত পাহাড় থেকে সমুদ্রের গভীরতা পর্যন্ত অনেক প্রজাতি তাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য না হারিয়ে টিকে আছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে, জীববৈচিত্র্য হলো পানি, ভূমি, পরিবেশ সবকিছু। প্রজাতি ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বিশ্বের ১২ বিলিয়ন প্রাণীর একটি অংশ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের ৪৯ মিলিয়ন প্রজাতির আবাসস্থল।
গাছপালা, প্রাণী, অণুজীব সহ পৃথিবীর সমস্ত জীবন্ত বস্তুই মূলত জিন ও তাদের বাস্তুতন্ত্র। তিনটি ভিন্ন পর্যায়ে এগুলো বিবেচনা করা হয়, বংশগত বৈচিত্র্য, প্রজাতির বৈচিত্র্য ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য প্রাণীদের বিলুপ্তি রোধে সাহায্য করে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে ১৫০ টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়ে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশও এই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে মোট প্রজাতির সংখ্যা বারো হাজারের বেশি ও সরকার তাদের রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জীববৈচিত্র্য পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একই ইকোসিস্টেমের বিভিন্ন মানুষ পরস্পর নির্ভরশীলভাবে বসবাস করে। অতএব, প্রজাতির বৈচিত্র্য যেমন বৃদ্ধি পায় বা প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তেমনি বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতাও বৃদ্ধি পায়। বাস্তুতন্ত্রের যে কোনো একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রজাতির বিলুপ্তি মানে সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রজাতির খাদ্য শৃঙ্খলের বিঘ্ন ঘটানো। তাই বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনবদ্য ও অপরিসীম।
মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ ইত্যাদির জন্য সরাসরি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের কারণেই মানুষ প্রকৃতি থেকে তার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। মানুষ শুধু বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে খাদ্য পায় না। এছাড়াও ওষুধ, কাঠ, কাগজ, ফাইবার, রাবার, আঠা, রজন, ট্যানিন, ফুল ইত্যাদি পাওয়া যায়। একইভাবে মাছ বিভিন্ন প্রাণী থেকে মাংস, দুগ্ধজাত দ্রব্য, চামড়া, পালক, উল, বার্ণিশ, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে। আবার বিভিন্ন জীবাণুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা যায়। এক কথায় মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্য ও স্বাস্থ্যের জন্য জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। যে কোনো দেশের জীববৈচিত্র্যই সে দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী প্রকৃতিকে করে তোলে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর। এই সম্পদের নমুনাগুলো চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষণ করা হয় যাতে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়। ফলে নান্দনিক সৌন্দর্য ও শিক্ষাগত মূল্য বৃদ্ধি পায়। একটি স্টাডি দেখেছে যে স্বাদুপানির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর, সরীসৃপ ও মাছ ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ফলস্বরূপ, করোনার মতো জেনেটিক (অন্যান্য প্রাণী থেকে সংক্রামক রোগ) রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
পরিবেশ দূষণ রোধে জীবজগতের সামগ্রিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতার জন্য জীববৈচিত্র্য অপরিহার্য। গাছপালা পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখতে ও বৃষ্টিপাত ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নদী, খাল, বিল, পুকুর, হাওর ও বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাশয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, জলাভূমি পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখা, বর্ষাকালে বন্যা রোধ, শহরের জলাবদ্ধতা কমাতে, পানির চাহিদা মেটানো ও বর্জ্য শোধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষ ইচ্ছেমতো জলাভূমি ভরাট করছে। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য জলাভূমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে নদী, খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, হাওরের অভাব নেই, শুধুই সংরক্ষণের অভাব। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
আবার, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী, জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ব্যতীত কোনো ব্যক্তি, সংস্থা, সরকারি বা আধা-সরকারি এমনকি কোনো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা তাদের মালিকানাধীন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইন অমান্য করে প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এটি জলাভূমি নির্ভর মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবন বিশ্বের মানচিত্রে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। যারা এই বন নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলছেন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় সুন্দরবন অন্যতম শক্তি। তবে তেলের ট্যাংক ডুবে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ পানি, পরিবেশ দূষণ, চোরা শিকার ও বনাঞ্চলে শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
সংবিধানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বাংলাদেশের একটি মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নের জন্য যে কয়েকটি দেশ আইন প্রণয়ন করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সংসদ বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য আইন পাস করে। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের ৫ শতাংশের বেশি ও তার সামুদ্রিক এলাকার প্রায় ৫ শতাংশকে ঝুঁকিপূর্ণ, সুরক্ষিত ঘোষণা করেছে। প্রতিটি জীবেরই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এই ধারণাটি ১৯৯২ সালে বিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কিত জাতিসংঘ ঘোষণায় স্বীকৃত হয়েছিলো। তাই প্রতিটি প্রজাতির জীবন রক্ষা করা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিশ্বজুড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস।
সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)