
২০২৪- ২৫ প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও ঘাটতি অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ

সোহেল রহমান : [১] করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে টালমাটাল বৈশি^ক অর্থনৈতিক সঙ্কট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার ও রিজার্ভ সঙ্কট Ñএসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে।
[২] অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত এ বাজেট পেশ করেন।
[৩] একই সঙ্গে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং অর্থবিল ২০২৪ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন তিনি। [৪] এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হচ্ছেÑ ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা। [৫] প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় হার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
[৬] মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
[৭] মূল্যস্ফীতি ছাড়াও ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধ এবারের বাজেটের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে।
[৮] অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তাবিত বাজেটে করভিত্তি সম্প্রসারণ ও করহার বৃদ্ধি ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
[৯] প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বাড়ছে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
[১০] প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছর শেষে টাকার অঙ্কে জিডিপি’র আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বিপরীতে সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ও অন্যান্য আদায়
[১১] প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন তথা রাজস্ব আদায়। এ বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ব্যয়-সক্ষমতা বাড়াতে হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ এদিক থেকে সমতুল্য অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি’র অনুপাত ৮ শতাংশের নীচে রয়েছে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে ১০ শতাংশের বেশি কর-জিডিপি অনুপাত অর্জন করা এবং রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা ও পরিমাণ বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক।
[১২] প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির (এনটিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদানের প্রত্যাশা করা হয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
[১৩] চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির (এনটিআর) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদান প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন
[১৪] প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ব্যতীত সার্বিক ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থ্বছরের মূল বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপি’র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণে আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
[১৫] অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নীট ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ৭২,৬৮২ কোটি টাকা ও স্বল্পমেয়াদী ঋণ ৬৪,৮১৮ কোটি টাকা) এবং ব্যাংক-বহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে।
[১৬] বাজেট ঘাটতি পূরণে বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য উৎস থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
[১৭] প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটে নীট বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে নীট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়
[১৮] প্রতিবারের মত এবারও বাজেটে পরিচালনা ও অন্যান্য খাতে (অনুন্নয়ন) ব্যয় বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৯৩ হাজার কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮২ হাজার কোটি টাকা) এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা); মূলধনী খাতে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯,০৩৪ কোটি টাকা); খাদ্য হিসাবে ১১৯ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০২ কোটি টাকা) এবং ঋণ ও অগ্রীম খাতে ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮,৪২০ কোটি টাকা) ব্যয় করা হবে।
[১৯] অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)-এর আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে মূল এডিপি’র আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
