
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণ নিয়ে টেনশনের কিছু নেই বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসার ব্যাপারে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী

সোহেল রহমান : [১] সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে চলতি পঞ্জিকা বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
[২] শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটাই জুড়ে ছিল মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য, ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণ, কালো টাকা সাদা করা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত ইত্যাদি বিষয়।
[৩] অর্থমন্ত্রী বলেন, ৯ শতাংশের মূল্যস্ফীতি আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। শুধু আমাদের একার চ্যালেঞ্জ নয় বিশে^র অন্যান্য দেশেও এটি একটি সমস্য। বৈদেশিক মুদ্রার অবমুল্যায়ন মূল্যস্ফীতির বড় কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং আরও কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়Ñ তা পর্যালোচনা করছি। বাজেটের আকার আমরা কমিয়ে রেখেছি, যাতে দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো চাপ না পড়ে। কর কাঠামোতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কর কমানো হচ্ছে। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনাসহ ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির জন্য কাজ করা হচ্ছে।
[৪] একই প্রসঙ্গে অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়েছে। আমরা আশাবাদী, যেসব উদ্যোগ নিয়েছি তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বিশেষ করে ইন্টারেস্ট রেট সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আমরা আশাবাদী, আগামী বছর আমাদের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে পারবো।
[৫] বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে সরকারের বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবেÑ এমন সমালোচনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া দোষের কিছু না। সব সময়, সব সরকারই বাজেট ঘাটতি মিটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়। এটা একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিওর। পৃথিবীর সব দেশেই বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়। সব দেশেই এটা চলে আসছে। তবে এছাড়া ঘাটতি মোকাবিলায় এবারের বাজেটের আকারও ছোট রাখা হয়েছে। কাজেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে টেনশনের কিছু নেই।
[৬] একই প্রসঙ্গে অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হলেও ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব পড়বে না। ব্যাংকের তারল্যের সঙ্গেও ঋণ নেয়ার লক্ষ্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া আমরা এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি। রাজস্ব বাড়লে ব্যাংক ঋণের ওপরে চাপ পড়বে না। তাছাড়া এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী বৈদেশিক ঋণের চাপ কমাতে আমরা অভ্যন্তরীণ উৎসের দিকে আছি। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদহার বেশি হওয়ায় সেখান থেকেও আমরা কম অর্থ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
[৭] উল্লেখ্য, ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি এ অর্থের ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে।
[৮] এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণ কমানো সরকারের অন্যতম টার্গেট। আর ঋণখেলাপি একদিনের নয়, দীর্ঘদিনের। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া নৈমিত্তিক কাজ। ব্যাংকে টাকা রাখলে তো সুদ বাড়ে। ব্যাংক এসব সুদ কীভাবে দেবে? এজন্য ব্যাংক টাকা বিনিয়োগ করছে। এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী চলমান। ব্যাংকের ব্যবসা বন্ধ না করে চালু রাখতে হবে।
[৯] বাজেটে সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ি কেনার প্রস্তাব বাতিলের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে এটি প্রস্তাব করা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে এটি বাতিল করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। এজন্য সময় লাগবে।
[১০] এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটা এরশাদ সাহেব চালু করেছিলেন। একটা বিষয় চালু হলে সেটা বন্ধ করা কঠিন।
[১১] রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআর-এর জনবল বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান বলেন, জনবল নিয়োগের বিষয়ে এনবিআর থেকে চিঠি এসেছিল। ইতোমধ্যে আমরা ব্যাপক জনবল বাড়িয়েছি। আশা করছি সামনে আরও বাড়ানো হবে।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, কর আদায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অটোমেশনের বিষয়টি শুরু হয়েছে। অর্থবিভাগ থেকে আমরা জনবল নিয়োগের বিষয়ে অনুমোদন পেয়েছি।
[১২] অর্থনীতির আকার ছোট হয়ে গেছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব বলেন, আমাদের চলতি অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ বছর বাজেট আরও বড় করা যেতো। কিন্তু করতে পারিনি মূল্যস্ফীতির জন্য। মুখে অনেক কিছু বলা যায়, আসলে মূল্যস্ফীতি মেজারমেন্ট করার জন্য কিছু টুলস আছে। তবে আমাদের সাপ্লাই চেইনে একটু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো আমরা সমাধানের জন্য চেষ্টা করছি।
[১৩] সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে বাজেটে কোনো উদ্যোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সুনীল অর্থনীতির গবেষণায় ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হেসেন চৌধুরী নওফেল বলেন, সরকারের ঋণ নিয়ে নেতিবাচক প্রচার করা হচ্ছে, যেভাবে প্রচার করা হয়েছিল কোভিডের সময়ে। আমাদের ঋণ এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নীচে। অন্যদের তুলনায় এখনও অনেক ভালো আছি আমরা। জিডিপির ৩০তম দেশ আমাদের। আমরা বাজেটে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাছাড়া কোন দেশের বাজেটেই লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ পূরণ হয় না। উন্নত দেশে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের ওপরে, আমেরিকায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঘাটতি। আমাদের ঘাটতি বাজেট ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
