গাইবান্ধায় কৃষকের পকেট কাটছে
গাইবান্ধা প্রতিনিধি : [১] খাজনা দেওয়া লাগে মণ প্রতি ৮০ ট্যাকা, কাটা (ওজন) করতে দেওন লাগে মণ প্রতি ৮০ ট্যাকা। আবার এক মণ শুকনো মরিচ লোড-আনলোড করতে লেবারকে (শ্রমিক) দেওন লাগে বস্তা প্রতি ৮০ ট্যাকা। [২] নদী ভাঙতে ভাঙতে হাটের জায়গাও এখন কমি গেছে। হাটত এমন কোন জায়গা নাই যে, ঝড়-বৃষ্টি হলে মাল নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে পারুম (পারবো)। অনেক কষ্ট করি মরিচ আবাদ করি। কম ট্যাকা খরচ হলে হামার জন্য ভালো হতো। এমনিতেই এবার মরিচের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এক মণ মরিচ বেচপ্যার (বেচা) আসি এমরা যেভাবে অর্থ চুষি নেয়, এটা হামার মতো কৃষকের উপর জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। [৩] এভাবেই হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার এড়েন্ডাবাড়ি চর থেকে আসা মরিচ চাষি ছামাদ মিয়া। গত মঙ্গলবার তিনি ফুলছড়ির গজারিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র ঘাট সংলগ্ন হাটে শুকনো মরিচ বিক্রি করতে এসেছিলেন। [৪] ভুট্টার পাশাপাশি জেলার ব্রান্ডিং পণ্য শুকনো লাল মরিচ। প্রতি বছরের মতো এবারও গাইবান্ধার ফুলছড়িতে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। নদী বেষ্টিত এই জেলার সাত উপজেলার ১৬৫ চরে মরিচ চাষ বেশি হয়। জেলার একমাত্র মরিচের হাট বসে ফুলছড়ি হাটে। এতবড় মরিচের হাট উত্তরবঙ্গের আর কোথাও নেই।
[৫] ঐতিহ্যবাহী এই হাটে বিশ্রামাগার না থাকা, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি পানের ব্যবস্থা না থাকা, অতিরিক্ত খাজনা আদায়, লেবার ফি, আড়তদারি থেকে মণ প্রতি কাটা (ওজন) করতে এক কেজি মরিচ নেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন অনেক কৃষক ও পাইকাররা। এদিকে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইজারাদারকে সরকার নির্ধারিত খাজনা আদায়ের মূল্য তালিকা হাটে টাঙিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও এমন দৃশ্য দেখা যায়নি।
[৬] ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ১৪ এপ্রিল থেকে (১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১ বৈশাখ থেকে) আগামী এক বছরের জন্য ফুলছড়ি হাটের সরকারি ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫৭ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। টেন্ডারের মাধ্যমে পরবর্তীতে ফুলছড়ি হাটের ইজারা মূল্য নির্ধারণ হয় ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। হাটের ইজারা পান অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন নামের এক ব্যক্তি।
[৭] গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরের পথ ফুলছড়ি হাটের। প্রসস্থ সড়ক গাইবান্ধা থেকে বগুড়ার সোনাতলা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় সব ধরনের যানবাহনে সরাসরি যাওয়া যায় এই হাটে। উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র ঘাট সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত হাটটি। সপ্তাহে দুই দিন শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এই হাট। চলে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। প্রতি হাটে তিন থেকে চার কোটি টাকার শুকনো মরিচ বিক্রি হয়। সেই হিসেবে মৌসুম সময়ে মাসে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মরিচ বিক্রি হয় এই হাটে।
[৮] ফুলছড়ি ছাড়াও বিভিন্ন চর থেকে এই হাটে প্রচুর মরিচ আনেন কৃষক ও পাইকাররা। এরমধ্যে টেংরাকান্দি, মোল্লারচর, খোলাবাড়ি, ফজলুপুর, এরেন্ডবাড়ি, উড়িয়া, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি চর অন্যতম। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বকশিগঞ্জের কয়েকটি চর থেকেও মরিচ বিক্রি করতে আসেন কৃষক ও পাইকাররা।
[৯] ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু মন্ডল বলেন, হাটে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করলে ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি ফুলছড়ি উপজেলায় নতুন যোগ দিয়েছি।
[১০] হাটে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বিক্রেতাদের জন্য আলাদা আলাদা ছাউনি না থাকার বিষয়টি দু:খজনক অবহিত করে তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
[১১] গাইবান্ধা জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, চলতি বছর ১ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। নদী বেষ্টিত গাইবান্ধার ১৬৫ চরে এসব মরিচের চাষ হয়। শুধুমাত্র ফুলছড়িতেই ৬৫ ভাগ মরিচ উৎপাদন হচ্ছে। প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী বছর থেকে জেলার পাঁচ উপজেলায় কৃষি পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে সরকার। তখন কৃষকের দুর্ভোগ কমবে।
[১২] অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কাজি নাহিদ রসুল জানান, অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের বিষয়টি তার জানা ছিল না। ওখানকার (ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ইউএনও নতুন এসেছেন। তাই হয়তো তিনিও জানেন না। খোঁজ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।