
ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে যে উদ্যোগ অপরিহার্য

বদরুল হুদা সোহেল : বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত ব্যাংকিং খাত নিয়ে খুব সম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন আমাদের উদ্বেগকে আরও গভীর করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে যে বগুড়ার আদমদীঘি চাঁপাপুর ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট আউটলেটের গ্রাহকদের জমা করা ১.৫০ কোটি টাকা অনুপস্থিত। মাত্র দুই দিন পর, ৩ জুন প্রায় সব মিডিয়ায় আরেকটি ভয়ঙ্কর খবর দেশের শিরোনামে আলোচনার একটি হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংকের লকার থেকে নিখোঁজ হওয়া ১৪৯ ভরি সোনা। হারিয়ে যাওয়া সোনা আজকের বাজারে ১৮ ক্যারেট হলে ১.৪২ কোটি টাকা ও ২২ ক্যারেটের ক্ষেত্রে ১.৭৪ কোটি টাকা। ব্যাংক হোক বা ক্লায়েন্ট, উভয়ই উদ্বেগজনক খবর আমাদের মধ্যে চরম হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে না, আতঙ্কও তৈরি করে। আমি শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তার আগে একটু পিছিয়ে যেতে চাই। সাহিত্যের একজন শিক্ষক হওয়ার কারণে আমি জানি ব্যাংকিং কার্যক্রম ও তাদের প্রাসঙ্গিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণার অভাব থাকতে পারে। তবে অবশ্যই এতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। সংবাদপত্রের আর্থিক পাতায় নিয়মিত চোখ বুলিয়ে নিলে আমাকে অন্তত এটা জানতে ছাড়ে না যে, দেশের কিছু ব্যাংক কমবেশি আজ পঙ্গু ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
বছরের শুরুতে ব্যাংকিং খাতের এই ভঙ্গুরতা কাটিয়ে উঠতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের আর্থিক শক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন রঙে দুর্বল, শক্তিশালী বা মাঝারি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এই খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলো, তবে কিছু ব্যাংকের জন্য এই ধরনের রঙের বিভাজন হোলি খেলার রঙে পরিণত হয়েছে। একটি জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ হিন্দু উৎসব যা রঙের উৎসব হিসেবে পালিত হয় এর জন্য। কিছু ব্যাংক এটি অসম্মান ও কলঙ্কের রঙ হয়ে ওঠে। এ ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থা দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়ায় আমানতকারীরা আতঙ্কে আমানত তুলে নিতে ঝুঁকে পড়েছেন। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক যে ব্যাংকটি বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নাম দিয়ে তার নীতিকে ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। তারল্য সংকটের কারণে এটির প্রথম প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছিলো কারণ খবরে দেখা যায় যে ব্যাংকটি তার সাধারণ আমানতকারীদের সামান্য পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আজ এটি কেবল তারল্য বা আর্থিক সংকট নয় গ্রাহকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠা এখন তাদের কারও কারও জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর উপর দ্বিতীয় আঘাতটি আসে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্থাগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শ দেয় যদিও অনেক বিশ্লেষক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবিত একীভূতকরণ পদ্ধতির নীতি থেকে ভিন্ন ছিলো। পরামর্শগুলো মেনে চলার জন্য তাদের মধ্যে অনেকেই সম্মত হন। কিছু ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একত্রীকরণ প্রক্রিয়ায়। যাত্রায় দুর্বল ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠা তো দূরের কথা এখন তারা নিজেদের পরিচয়ের সংকটে ভুগছে। যে কারণে এটা ডুবে যাওয়া ইঁদুরের ওপর জল ঢেলে দেওয়ার মতো। নিয়মিত গ্রাহকরা তাদের জমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে আজ বা পরদিন তৃতীয় ব্যাংকে জমা দেওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগছেন ও ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন একীভূতকরণ থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে।
মহামারীর আগেও যে ব্যাংকগুলো তাদের যুবকদের শক্তিশালী তারল্যের সঙ্গে পাস করেছিলো তারা এখন তাদের ভাবমূর্তি ও গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ক্লায়েন্ট, প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ছুটছে। তাদের অনেককেই ক্লায়েন্টদের বোঝানোর জন্য বিভিন্ন স্কিমের অধীনে আকর্ষণীয় ও উচ্চ হারের মুনাফা বা সুদের বিজ্ঞাপন করতে দেখা যায়। অতীতে আমাদের ব্যাংকের যে চিত্র আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি তা ছিলো না। ব্যাংকগুলো কিভাবে তলানিতে গেলো? দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি-অনিয়ম, অর্থহানি ও মন্দ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘাটতি এখন তাদের কপালে। বিচক্ষণ ব্যাংকাররা এই পরিস্থিতির অনেক কারণ উল্লেখ করতে পারেন। আমরা যারা ভরের মধ্যে আছি তারা কারণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি- একটি অভ্যন্তরীণ অন্যটি বাহ্যিক। প্রথম কারণের তীরের সামনে কিছু অসাধু কর্মকর্তা, অসাধু পর্ষদ সদস্য ও ব্যাংকের মালিকরা। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক খোদ কেলেঙ্কারিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো, ব্যাংক কর্মকর্তারা কেন দোষীদের নাম প্রকাশ করবেন? তারা কী নিজেদের কবর খুঁড়বে? সৌভাগ্যবশত মিডিয়ার কল্যাণে তারা কারা ও কেন নিয়ন্ত্রক ব্যাংক প্রকাশ করতে অনিচ্ছা দেখায় সে সম্পর্কে আমাদের জানার বাকি নেই। দ্বিতীয় স্তরের অগ্রভাগে রয়েছে নন-ব্যাংক অসুস্থ ব্যক্তি, অপরাধী রাজনীতিবিদ ও মাফিয়া গ্যাং যারা দিনরাত ব্যস্ত থাকে ব্যাংকগুলোকে দূরে রেখে অর্থ কারসাজি করার চেষ্টায়।
২০১৪ সালে কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকে দীর্ঘ টানেল তৈরি করে ফিল্মি স্টাইলে টাকা চুরির ঘটনা আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তুলেছিলো। এর ধারাবাহিকতা শেষ হয়নি। একের পর এক ঘটনা ঘটছে এক পর্যায় নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে গত ঈদুল ফিতরের আগে বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকের ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যাংক চুরির ঘটনা এখন ডাকাতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকে জমা টাকার নিরাপত্তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে ঠিক তখনই চট্টগ্রামের চকবাজারে ইসলামী ব্যাংকের লকার থেকে হঠাৎ করে ১৪৯ ভরি স্বর্ণ গায়েব হওয়ার খবরে আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়েছে। এই দুর্ঘটনার আতঙ্ক এখন আমানতকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যাংকের ভল্ট লকারে ঢুকে পড়েছে। গ্রাহকরা প্রধানত মূল্যবান নথিপত্র, কাগজপত্র, অলঙ্কার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক লকার ভাড়া করে যাতে তাদের মূল্যবান জিনিসগুলো সর্বাধিক নিরাপত্তার জন্য নিশ্চিত করা যায়। ব্যাংক লকার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে আমি আমার ফ্রেন্ডলিস্টের বেশ কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কথার সারমর্ম ও চকবাজার ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের মিডিয়ার সামনে দেওয়া বক্তব্য অভিন্ন। প্রক্রিয়াটি চলে ভল্টের প্রতিটি লকারে দুটি ভিন্ন চাবি থাকে। একটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে ও অন্যটি গ্রাহকের সঙ্গে থাকে। দুটি চাবি একযোগে ব্যবহার ছাড়া লকার খোলা যাবে না। নিয়মানুযায়ী, ইনচার্জ প্রথমে তার মাস্টার চাবি ব্যবহার করেন ও তারপর গ্রাহক তার চাবিটি চাবির গর্তে (কী স্লট) ঢুকিয়ে লকারটি খোলেন। এ সময় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। গ্রাহক তার লকারে কী রাখেন তা জানার বা দেখার কোনো সুযোগ বা বিকল্প নেই ব্যাংকের। গ্রাহক কাজ শেষে তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে লকারটি লক (বন্ধ) করে। গ্রাহক বের হলে ব্যাংক কর্মকর্তা তৎক্ষণাৎ লকার রুমের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লিখিত আকারে আগেই বলেছে যে ইসলামী ব্যাংক লকার ব্যবস্থাপনায় কোনো অসঙ্গতি করেনি। অপরদিকে, ব্যাংকের গ্রাহক রোকেয়া আক্তার কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে ব্যাংকের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ঘটনাটি নিয়ে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করলেও বাস্তবে তাদের দুজনেরই কেউ ভুল করেছে বা কৌশল অবলম্বন করেছে। আমার প্রশ্ন হলো লকারের নিরাপত্তা যদি এতোটাই কড়া হয়, তাহলে ওপেন সিসেম থিওরি, ভল্টের দরজা খোলার জন্য আলী বাবা যে ম্যাজিক কমান্ড ব্যবহার করেছিলেন, তা এখানে কীভাবে কাজ করলো? গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলবশত লকারে অনুপস্থিত করেছেন কিনা তা আনলক করাও একটি বিষয়। এই দুটি অনুষঙ্গ ছাড়াও তৃতীয় কোনো বাহ্যিক দুষ্ট চক্র আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। জানা গেছে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জুন হঠাৎ করে সব ব্যাংকে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমাদের দেশে রেওয়াজ আছে যে ঘোড়া চুরি হলে সবাই আস্তাবলের দরজায় তালা লাগাতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে অনিয়ম নিরসনে কোনো অতিপ্রাকৃত তত্ত্ব প্রয়োগ করছে তা স্পষ্ট নয়। প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাতায়াতের পথ সাংবাদিকদের ব্যবহার করা হয়েছে এখন অসমান কাঁটা ছিটিয়ে। নিয়ন্ত্রক ব্যাংক কোনো ধরনের অসঙ্গতি বা অনিয়মের দায় এড়াতে পারে না। মনে রাখতে হবে দেশের ব্যাংকগুলো যদি অর্থনীতির চাকা হয়, তাহলে সেই চাকার গতি নিয়ন্ত্রণের স্টিয়ারিং বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। নিজের কোনো দোষ ছাড়াই ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হওয়া যেমন কাম্য নয়, তেমনি গ্রাহকদের বিরক্ত বা হয়রানির শিকার হওয়াও কাম্য নয়। লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইশাখা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার
