
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জরুরি

শরিফুল হাসান
বাংলাদেশি বাবাদের দুর্নীতি লুটপাট আর পাচার করা টাকায় কতো যে সন্তান বিদেশে রাজকীয় জীবনযাপন করে আর বেগমপড়ায় কতো যে বেগমরা থাকেন সেই তালিকা কখনো আমরা পাবো না। বেগমদের সাহেবরা তো ধনীই উপরন্তু বিদেশে তাঁরা ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছেন বিনিয়োগকারী কোটায়। খরচ বেশি নয়; মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার, অর্থাৎ এক কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডা আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। বেগমদেরও এই পরিমাণ টাকা দিতে হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন প্রবাসে নিরাপদ ঘর। তবে বেগম পাড়ার সাহেবরা কিন্তু বছরের বেশির ভাগটা নিজের দেশেই কাটান। তারা সেখানে টাকা বানাবার মেশিন চালু রাখেন। যখন প্রয়োজন বা বিপদে পড়েন শুধু তখন তারা বেগমপাড়ায় আসেন। আফসোস কয়েক বছর পেরিয়ে গেলো, পদ্মা যমুনায় বহু জল গড়ালো, কানাডায় সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর ভাইসহ অনেকে এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেন, আদালত নির্দেশও দিলো কিন্তু জানা গেলো না সাহেবদের পরিচয়।
যারা বৈধভাবে বিদেশি সম্পদ করেছেন তাদের বিষয়ে বলার কিছু নেই কিন্তু যারা অবৈধভাবে সম্পদ করেছেন তাদের বিষয়ে আপত্তি আছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন একবার বলেছেন, বিদেশে টাকা পাচারের সত্যতা মিলেছে। তবে রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিলো রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর টাকা পাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশরের ভূমিকায় (দুদক) অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাই কোর্ট বেঞ্চ দুদকের কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খানকে আদালতে বলেন, ‘বিদেশে এতো লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি। উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকা আসবে কি আসবে না, সেটা পরে দেখা যাবে।’
আফসোস কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দুবাইতেও একদল বাংলাদেশি বিপুল সম্পদের মালিক। যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর কোথায় তাদের সম্পদ নেই? আমি বেশ কয়েকবার লিখেছিলাম এমন যদি করা যায় যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সব জনপ্রতিনিধি এবং সচিব থেকে শুরু করে সব সরকারি কর্মকর্তাদের একটাই পাসপোর্ট হতে হবে। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের পাসপোর্ট তাদের থাকতে পারবে না। দেশের বাইরে তাদের কোনো বাড়ি এবং সম্পদ থাকবে না। তারা নিজেরা এবং তাদের সন্তানদের সবার আগে দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাবেন। গণপরিবহনে চড়বেন। পাবলিক স্কুলে সন্তানদের পড়াবেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি সব সেবা নিতে বাধ্য থাকবেন। এগুলো করা গেলে হয়তো বাংলাদেশটা বদলে যাবে। আসলে আমরা কপালে পোড়া জনগণ। ভেবে দেখেন, আমাদের জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-আমলারা কথায় কথায় দেশের মঙ্গলের কথা বলেন, দেশসেবা করছেন দাবি করেন, অথচ নিজেরা সরকারি হাসপাতালে যান না। সরকারি স্কুলে সন্তানদের পড়ান না। গড়ে তোলেন বেগমপাড়া। টাকা পাচার করেন বিদেশে।
জানি লিখে খুব একটা লাভ নেই। কারণ এই দেশ থেকে যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, যারা বেগমপাড়ায় কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করে তারা তো কেউ সাধারণ জনগণ না, কৃষক না। তারা তো সব বড় মানুষ, অনেক ক্ষেত্রে তারাই তো নীতি নির্ধারক। গতকাল লিখেছিলাম, আপনার বাবার আয়টা হালাল তো? আপনার আত্মীয় যাকে নিয়ে এতো গর্ব করছেন তিনি সৎভাবে আয় করেন তো? মনে রাখবেন আইজিপি, সচিব থেকে শুরু করে যতো বড় কর্মকর্তাই তিনি হন না কেন এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়াসহ সবমিলিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা তিনি পেতে পারেন। এই যুগে সব খরচ সামলে এই টাকা দিয়ে তিনি কীভাবে এতো সম্পদের মালিক হন, কী করে তাঁর এতো গাড়ি বাড়ি থাকে, কী করে তিনি আপনাকে বিদেশে বা দামী স্কুলে পড়ানোর টাকা দেন আপনার সেই প্রশ্ন তোলা উচিত। শুধু সরকারি চাকরিজীবী নন, আপনার বাবা বা স্বজন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, বিচারক, সাংবাদিক, শিক্ষক, উপাচার্য, প্রক্টর, প্রকৌশলী, বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা যাই হোন না কেন আপনি যদি গাড়ি বাড়ি থেকে শুরু করে অঢেল সম্পদ দেখেন এবং যখন যা চান তাই পেয়ে থাকেন কিন্তু আপনাদের জমিদারি না থাকে তাহলে তাঁর সম্পদের উৎস নিয়ে সন্দেহ করুন। প্রশ্ন তুলুন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা সামাজিক আন্দোলন জরুরি।
আসলে একটা ভয়াবহ সমাজব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে আমরা। এইতো ২০-৩০ বছর আগেও যে লোকটা দুর্নীতি করতো তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকাতো। আর আজকে যে কোনো ভাবে টাকা আয় করলেই, গাড়ি বাড়ি সম্পদ থাকলেই আমরা তাদের তোয়াজ করি?। মসজিদ কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে নানান পথ পদবীতে বসাই?। নানাভাবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চাই। অথচ এই নোংরা কিটগুলোর আশ্রয় হওয়া উচিত ছিলো জেলখানায়। কথাগুলো বলছি, কারণ এই বাংলাদেশ সংকটটা যতোটা না অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি মানবিক মূল্যবোধের। সত্যিকারের সব সৎ কর্মকর্তা কর্মচারীকে শ্রদ্ধা এবং সব দপ্তরেই এমন কর্মকর্তা কর্মচারী আছেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা। তবে বাস্তবতা হলো একদল লোক দুর্নীতি লুটপাট করে টাকা পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আরেকদল মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেও কোনোমতে টিকে থাকতে পারছেন না। ভয়াবহ এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা দরকার। এই দেশের প্রতিটা বড় বাড়ি, ফ্ল্যাট দামি গাড়ির মালিকের সম্পদের উৎস সন্ধান করা উচিত। বিদেশে কাদের কাদের সম্পদ আছে এগুলো অনুসন্ধান করার জরুরি। আশায় থাকি যদি কোনোদিন এই রাষ্ট্রের হুশ ফেরে। আর যতোদিন সেটা না হয় সামাজিকভাবে আমরা যেন এই দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি। অন্তত প্রশ্ন তুলি। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে এই লুটপাটকারি দুর্বত্তদের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তুলতেই হবে। লেখক: কলামিস্ট
