
বাজেটে কর্মপ্রত্যাশী তরুণদের জন্য কি আসলেই কিছু আছে?
এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ : প্রস্তাবিত বাজেট চাকরিপ্রার্থী, বিশেষ করে তরুণদের জন্য হতাশাজনক। লোকেরা তরুণদের জন্য চাকরি ও মানসম্মত শিক্ষার জন্য বরাদ্দ আশা করেছিলো। তবুও ঘোষিত জাতীয় বাজেট উভয় দিক থেকেই কম ছিলো। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দ্বারা পরিচালিত ‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও নাগরিকদের আকাক্সক্ষা’ শিরোনামের একটি সাম্প্রতিক নাগরিক সমীক্ষা অনুসারে তিনটি শীর্ষ অগ্রাধিকার ছিলো উপযুক্ত চাকরি (২২ শতাংশ), মানসম্মত শিক্ষা (১৭.৫ শতাংশ) ও সামাজিক সুরক্ষা (১২ শতাংশ)। যারা শালীন চাকরিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বেকারত্ব কমাতে চেয়েছিলেন, যখন এক তৃতীয়াংশ চাকরির সুযোগ বাড়াতে চেয়েছিলেন। এবারের বাজেটে এসব অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয়নি। আওয়ামী লীগের ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুবদের জন্য চাকরি-ভিত্তিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা’ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফোকাস হিসেবে তালিকাভুক্ত করা বিবেচনা করে এটি আরও বিস্ময়কর। তাছাড়া এবারের নির্বাচনী প্রচারণার একটি স্লোগান ছিলো ‘তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি।’ এক দশক আগে আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও সাহসী দাবি করা হয়েছিলো যে, ‘…নিরক্ষরতা দূর হবে, শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ প্রচুর হবে, কোটি যুবকের কর্মসংস্থানের সঙ্গে বেকারত্ব শূন্যে নেমে আসবে।’
প্রকৃতপক্ষে, গত ১৫ বছরে তরুণদের নিয়ে এক ডজনেরও বেশি পরিকল্পনা, নীতি, আইন ও নিয়ম চালু করা হয়েছে। জাতীয় যুব নীতি ২০১৭, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০, প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ সকলেই যুবকদের কর্মসংস্থানের স্বীকৃতি, ঠিকানা দিয়েছে। এ২আই প্রকল্প স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট তরুণদের ধারণাকে প্রচার করেছে অন্যদিকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুব উন্নয়ন বিভাগও ‘স্মার্ট যুব, সমৃদ্ধ দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি সম্পূরক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জানুয়ারি ২০২০ সাল থেকে, আমরা জাতীয় যুব নীতি ২০১৭ বাস্তবায়নের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছি। তাহলে যুবপন্থী বাজেট এখনও অধরা কেন? বক্তৃতা লেখক ও রাজনৈতিক ইভেন্ট সংগঠকরা উচ্চতর যুব-পন্থী প্রতিশ্রুতি দিতে ও ভালো প্রচার, বার্ষিক প্রতিবেদনের জন্য যুবদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে বেশি খুশি। তবুও যখন প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা আসে তারা কর্মে অনুপস্থিত।
তারুণ্য ধোলাই বাড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ আওয়ামী লীগের ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের কথাই ধরা যাক। এটি শ্রমসাধ্যভাবে যুব উন্নয়নে সরকারের অর্জনগুলো তালিকাভুক্ত করেছে। ১৩ মিলিয়নেরও বেশি তরুণ ব্যক্তিকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে ও প্রায় এক মিলিয়ন যুবক আত্ম-কর্মসংস্থানে নিযুক্ত রয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ, স্ব-কর্মসংস্থান প্রকল্প, যুব ঋণ প্রকল্প ও দারিদ্র্য বিমোচন উদ্যোগের কারণে বেকারত্বের হার ২০০৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৩.৬ শতাংশে তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবুও, বাস্তবতা হলো আমাদের অধিকাংশ বেকার জনসংখ্যার বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। শুধু বাংলাদেশেই নয় দুই অঙ্কের যুব বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের বেশি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণে (এনইইটি) নেই এমন লোকের হারও বিশ্বব্যাপী গড়ে ২১.৭ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের অংশ যারা নিট বিভাগে পড়েন ২০১৭ সালে ২৮.৯ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৩৯.৮৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিস্ময়করভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরাও উচ্চ হারে ভোগেন। বেকারত্ব তবে এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়।
ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট দ্বারা যৌথভাবে পরিচালিত একটি ২০১৪ তুলনামূলক স্টাডি রিপোর্ট করেছে যে বাংলাদেশে প্রতি ১০ গ্রাজুয়েটের মধ্যে প্রায় পাঁচজন ভারত ও পাকিস্তানের ১০ টির মধ্যে প্রায় তিনজনের বিপরীতে বেকার ছিলো। উচ্চ নিট হারের কারণে বাংলাদেশের যুব শ্রমশক্তি সঙ্কুচিত হচ্ছে। অতএব ৯ জুন, ২০২৪-এর এই কাগজের একটি সম্পাদকীয়, সঠিকভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বাংলাদেশি যুবকদের জন্য কোনো আশা বা পথ দেখায় না। ঠিক যেমন ‘গ্রিনওয়াশিং’- বড় কর্পোরেশন ও সরকারগুলোর দ্বারা তাদের ক্রিয়াকলাপগুলোকে সাসটেইনেবল বা পরিবেশ বান্ধব হিসেবে বাজারজাত করার একটি অভ্যাস, যখন বাস্তবে তারা ক্ষতি করে আমাদের জাতীয় নীতি এজেন্ডায় তরুণদের উদ্বেগগুলো সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর আমরা ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ এর মতো নতুন খালি স্লোগান দিয়ে থাকি। বিভিন্ন ইয়ুথ ফোরাম ও গোষ্ঠীও প্রসারিত হয়েছে, আমাদের সরকার বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এই দল ও ফোরামকে স্থান দিয়েছে। কাগজে কলমে যুবকদের উদ্বেগ সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা নথিতে স্বীকৃত। তবুও তারা কংক্রিট কর্মের সঙ্গে দেখা হয় না অন্তত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে। কর্মসংস্থান ও দক্ষতার ক্ষেত্রে যুবদের অন্তর্ভুক্তি এখনও অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারেনি।
একদিকে পরিকল্পনার নথিতে তথাকথিত ‘যুবদের অন্তর্ভুক্তি’ ও এই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও অন্যদিকে যুব উদ্বেগগুলোকে বাজেটে বাদ দেওয়া আমাদের আইন প্রণেতাদের প্রকৃত অগ্রাধিকার সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য সস্তা উপাদান হিসেবে পরিবেশন করার বাইরে যুব এজেন্ডার কী কোনো মূল্য আছে? নাকি যৌবন ধোলাই শুধুমাত্র একটি উপসর্গ? সম্ভবত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের চালক হিসেবে যুবশক্তির প্রচার সত্ত্বেও শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে ভেঙে যাওয়া আন্তঃসম্পর্ক নীতিনির্ধারণে আরও মৌলিক ব্যবধানের প্রতিফলন। অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব। তাতে বলা হয়েছে ইয়ুথ ওয়াশিং বাংলাদেশের জন্য অনন্য নয়। জনপ্রিয় প্রচার ও বক্তৃতার জন্য সবুজ এজেন্ডাকে কাজে লাগানোর অনুরূপ, কর্তৃত্ববাদী শাসনের রাজনীতিবিদরা তরুণদের কণ্ঠস্বরকে ক্রমবর্ধমানভাবে শোষণ করছে কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতি সামান্য মনোযোগ না দিয়ে বা এই গোষ্ঠীর উত্থাপিত উদ্বেগের বিষয়ে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে একটি কার্যক্ষম উপায়ে তা করছে। তবে এই অনুশীলনটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে ব্যয়বহুল হতে পারে কারণ আমাদের প্রথম জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ উইন্ডো ২০৩০ ও ২০৪২ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কম বিনিয়োগ ঢাকতে রাজনৈতিক অভিজাতদের কৌশল হিসেবে যুব ধোলাইকে প্রতিহত করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী, তরুণদের গণতান্ত্রিক বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তর প্রক্রিয়া সহজতর করার দীর্ঘ উত্তরাধিকার রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক আন্দোলনগুলো তরুণ কণ্ঠকেও আকৃষ্ট করেছে যারা সম্মিলিতভাবে গ্রহকে বাঁচাতে ও তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের রূপান্তরমূলক সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদাররাও যুব নীতি বিকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করছে যাতে যুবকদের অধিকার ও সামাজিক সুযোগগুলোতে অ্যাক্সেস সহজতর হয়। জাতিসংঘও মানসম্পন্ন শিক্ষা, শালীন কাজ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও হ্রাসকৃত বৈষম্যের মতো এসডিজিগুলোর মূল হিসেবে যুব কর্মকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে, তরুণদের তাদের ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিতভাবে দর কষাকষি করতে হবে। চাকরি ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য সরকারকে দায়বদ্ধ রাখতে হবে। বাংলাদেশি নীতিনির্ধারকদের তাই জনসাধারণের কর্মের জন্য যুবকদের দক্ষতাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। যেমনটি ২০১৮ সালে সরকারি সেক্টরের চাকরিতে ন্যায্য, কোটা-মুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পিছিয়ে পড়ার সময়ে তরুণদের ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান অভ্যাস জনপ্রিয় প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে মানুষকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তরুণদের বেকারত্ব কমানোর জন্য নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতির জন্য রাজনীতিবিদদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে তরুণরাই স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১ এর পাশাপাশি ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর প্রধান স্টেকহোল্ডার। তাদের জন্য ‘জাতীয় যুব বাজেট’ প্রণয়নের জনসাধারণের প্রচারণার দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। যুব কর্মসংস্থানের জন্য একটি জাতীয় কৌশল।
লেখক : গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান, ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ডেইলি স্টার
