
কেন বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম আশেপাশের দেশ থেকে বেশি?

কাজী এম. মুর্শেদ
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম আশেপাশের দেশ থেকে বেশি। কাছাকাছি অর্থনীতির দেশগুলোর চেয়ে এই খরচ প্রায় ৭ গুণ বেশি। এর প্রধান দুইটা কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের ইন্টারনেটের প্রয়োজন বছরে প্রায় ৫০০০ গিগাবিট/সেকেন্ড। আমাদের সোর্স তিনটা। এর মধ্যে দুইটা সাবমেরিন কেবল দিয়ে, অন্যটা ভারত থেকে ল্যান্ড দিয়ে আসে। সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার লাইন গেছে। একটা ঝঊঅ-গঊ-ডঊ-৪ বা সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্টার্ন ইউরোপ যার বাংলাদেশে ড্রপ এসেছে কক্সবাজারে। এটা ২০০৬ সাল থেকে চলছে। অন্যটা ঝঊঅ-গঊ-ডঊ-৫ যার ড্রপ এসেছে কুয়াকাটা, এর শুরু ২০১৮ সালে। দুই লাইনে আমাদের যোগান আসে ২৩০০ গিগাবিট/সেকেন্ড। বাকি ২৭০০ গিগাবিট/সেকেন্ড ভারতের ওঞঈ ঝবৎারপব চৎড়ারফব থেকে কিনতে হয়। যে প্রয়োজনীয়তার কথা বললাম, সেটা কতো ফ্রিকোয়েন্সিতে আমাদের দরকার। তবে ২০২৫ সালে ঝঊঅ-গঊ-ডঊ-৬ চালু হবার কথা, সেইসময় ওঞঈ থেকে কম কিনতে হলে দাম কিছু কমার সম্ভাবনা আছে।
প্রথম কারণ বললাম, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে কেনা দাম যাই হোক, আমাদের ওঝচ গুলো এখন প্রায় ৯০ শতাংশ কম দামে সরকারের কাছ থেকে কিনলেও দাম কমাতে উৎসাহী না। আগের দাম যা ছিলো সেখানে রেখে থ্রুপুট কিছু বেশি দেয় তাও দয়া করে। মাঝের টাকা বানাচ্ছে এসব আইএসপি গুলো। বাংলাদেশে ইন্টারনেট আসে ১৯৯৬ সালে, তখন অত্যন্ত দামি ঠঝঅঞ মারফত দেওয়া হতো। ১৬ কিলোবাইট, ৩২ কিলোবাইট, ৬৪ কিলোবাইট, ১২৮ কিলোবাইট এই রকম করে আস্তে আস্তে বেড়েছে যতোদিন পর্যন্ত সাবমেরিন কেবল না আসে। একটা সময় ঠঝঅঞ গুলো বন্ধ করতে হয়, কারণ শুধু সাবমেরিন কেবলে দাম সস্তা একটা কারণ, যেখানে ঠঝঅঞ গুলো ক-ইধহফ, ঈ-ইধহফ এবং কট-ইধহফ ব্যবহার করতো যার জন্য বিদেশে স্যাটেলাইট কোম্পানিকে টাকা দিতে হতো।
এবার অন্য কথায় আসি। আমরা সাধারণত ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করি। এর ফ্রিকোয়েন্সি বেশি, সেজন্য পয়েন্ট টু পয়েন্ট ঠঝঅঞ এর বদলে শেয়ারড লাইন ব্যবহার করা যায়। যেখানে ১ মেগাবিটের যা দাম ছিলো, সাবমেরিন কেবলে ১০ মেগাবাইট দিলেও শেয়ার করে কাজ করা সহজ। যখন লোড বেশি হয়, তখন কিছুটা স্লো হয়। না হলে মোটামুটি চলে যায়। একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, একটা ভিডিও চালান রাতের বেলায় রাত ১২ টা থেকে সকাল ৬টা যখন অফ পিক আওয়ার, খুব সহজে চলবে। কিন্তু পিক আওয়ার সাধারণত সকাল ৯ টা থেকে ১২ টা এবং দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৫ টা। এই ১২ ঘণ্টা সময়ের বাইরে যে ১২ ঘণ্টা, সেই সময়টায় মোটামুটি ঠিকমতো চলে তবে অফ পিক আওয়ারের মতো না। ব্রডব্যান্ডের হিসেব বুঝলেন, ফাইবার অপটিক কেবলে মোটামুটি ঠিকমতো চলে এবং সেটা ১০/২০/৩০/৪০/১০০ এইরকম গিগাবিট ফ্রিকোয়েন্সিতে। দাম মাসিক নির্দিষ্ট করা। অন্য কথায় আসি।
আরেকভাবে ইন্টারনেট বিক্রি হয় যেটা মোবাইল কোম্পানি বিক্রি করে ১/২/১০ গিগাবিট হিসেবে। এটা সবসময় অনেক খরচের ব্যাপার। এর কারণ গিগাবিট কথাটা। ব্রডব্যান্ড লাইনে যেখানে ফ্রিকোয়েন্সি গিগাবিট/সেকেন্ড, সেটা যতো ইচ্ছা ততো গিগাবিট আপলোড ও ডাউনলোডের জন্য হোক না কেন- মোবাইল কোম্পানিগুলো বিক্রি করে গিগাবিট হিসেবে। এইখানেই বড় একটা ফাঁকি। গিগাবিট/সেকেন্ড হলো ফ্রিকোয়েন্সি, আর মোবাইল কোম্পানি বলে কতো গিগাবিট ডেটা আপনাকে দিচ্ছে। আপনি ফ্রিকোন্সি দেখতে পারেন, ৯-২২ গিগাবিট/সেকেন্ডে পাবেন। দাম বাড়ার আরেকটা কারন হলো, ফাইবার অপটিক কেবল লে আউট। কক্সবাজার ও কুয়াকাটা থেকে ঢাকা হয়ে নেশন ওয়াইড লাইন বা ঘঞঞঘ ছড়ানো আছে। এখানে গ্রামীণফোনের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তি মারফত বিভিন্ন জেলায় রেললাইন ধরে যে ফাইবার অপটিক কেবল বিছানো তার একটা খরচ আছে। সেই সঙ্গে সামিট কমিউনিকেশন ও ফাইবার এ্যাট হোম এই দুইটা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সারা বাংলাদেশে ফাইবার ছড়ানো। তাদের একটা খরচ আছে।
খরচের কথা বললাম, এরপরও বিটিআরসির বিশাল লাভজনক খাত এটা। সরকারেরও ভ্যাট ও সারচার্জের বড় খাত। এই লাভের টাকা আমাদের পকেট থেকে যায়। যেই সাতগুণের কথা বললাম, সরকার সারচার্জ কমালে এবং আইএসপি দাম সমন্বয় করলে আমাদের খরচ পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এই আইএসপি ব্যবসা এতো লাভজনক, এদের ফোনের আর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় আছি। ঈদের আগের দিন হাঁটতে বের হয়েছি, কয়েকটা নাম চোখে পড়লো, মায়ের দোয়া আইএসপি, সুলতানা আইএসপি, মুক্তি আইএসপি, মাইম বা মহিম আইএসপি, ক্লিক আইএসপি ইত্যাদি। ব্যবসায় লাভ আছে কোনো সন্দেহ নেই, সমস্যা হলো, আপনি হুট হাট করে নতুন কোনো আইএসপি আসলেই আপনার বর্তমান লাইন ফেলে মাসে একশত টাকা বাঁচাতে যাবেন না। ফলাফল এই আইএসপিগুলো মার্কেটিং বোঝে না, কয়দিন পর আবার চাল ডালের আড়তের আর কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসায় ফেরত যায়। বিটিআরসির বা বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসির রিপোর্ট অনুযায়ী তারা যথেষ্ট আয় করছে। আয় কমালে জনগণ আরো গতি সম্পন্ন লাইন পেতো।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
